একটা সময় ছিল যখন স্মার্টফোন ছিল একটি দুর্লভ বিষয়। সেই সময় মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বই পড়া, গল্প করা। অনেক সামর্থ্যবানের বাড়িতে থাকত নিজস্ব গ্রন্থাগার। সেসব এখন শুধুই অতীত গল্প। এ যুগে ঘরে ঘরে পাঠাগার না পাওয়া গেলেও স্মার্টফোন ঠিকই পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষের শরীরের জন্য যেমন খাদ্যের দরকার, তেমনি মনের প্রয়োজন ‘খাদ্য’। এই প্রয়োজন মেটাতে পারে ‘একটি ভালো বই’। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারাচ্ছে বইয়ের প্রতি। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো আগামী প্রজন্ম আস্তে আস্তে ভুলেই যাবে বই পড়ার কথা!
টুইটার, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন এক ব্রিটিশ লেখক। বুকার পুরস্কারজয়ী লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকসনের উদ্ধৃতিতে জানা যায়, স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমাণে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে নাটকীয়ভাবে। আর মূলত এ কারণেই তারা হারাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস। এক্ষেত্রে তিনি শুধু তরুণ প্রজন্মের কথাই বলেননি, বরং সেই সঙ্গে নিজের অবস্থাও তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেও বইয়ের প্রতি আর তেমন মনোযোগ দিতে পারেন না। তার মনোযোগের একটা অংশও চলে যায় মোবাইল কম্পিউটারের স্ক্রিনের পেছনে!
একসময় আমাদের দেশে ডাকহরকরা ছিল। যত্নে লেখা চিঠি প্রিয়জনের ঠিকানায় পৌঁছে দিত। এখন মোবাইল এসএমএসের যুগ। পরীক্ষা ছাড়া হাতে লেখালেখি প্রায় হয়েই ওঠে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার মধ্যে দিয়ে পৃথিবী এগিয়েছে। যতই নতুন নতুন আবিষ্কৃত হচ্ছে, ততই মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে যান্ত্রিকতায় মগ্ন হচ্ছি আমরা। আমরা আজ যন্ত্রের দখলে! দিনের ২৪ ঘণ্টার একটি বড় অংশই কাটছে যন্ত্রের সঙ্গে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষার মান অনেক নেমে গেছে। ১৯৮২ সালের পর গত বছর প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাহিত্য পড়ার হার সবচেয়ে কম ছিল। বছরটিতে কেবলমাত্র একটি বই পাঠ করেছেন মাত্র ৪৩ শতাংশ মানুষ।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩৩ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। এদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। ফেসবুককে যারা পজিটিভলি ব্যবহার করছেন, তারা এর সঠিক ব্যবহারটাই করছেন। তবে এ সংখ্যা হাতেগোনা। অধিকাংশই সময় পার করেন কোন বন্ধু কী পোস্ট করছে বা কতজন তার দেওয়া পোস্টে লাইক বা কমেন্ট করছে—এসব নিয়ে। মূলত এই প্রবণতাটিই আমাদের তরুণ সমাজকে বই পড়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। লাইব্রেরিতে গিয়ে ভালো বই খোঁজাখুঁজি করে—এমন তরুণের সংখ্যা খুবই কম। এটা খুব একটা শুভ সংকেত নয়। এই অবস্থায় নতুন প্রজন্মকে বইমুখী করতে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন।
অনেকে অবশ্য মনে করেন, বর্তমানে ভালো ভালো বই প্রকাশ হচ্ছে কম। সে কারণে বইপাঠ-প্রীতি কমছে দ্রুত গতিতে। কেউ কেউ মনে করেন, বই বিমুখতার জন্য ব্যস্ত জীবনব্যবস্থাও দায়ী অনেকাংশে। আজকের শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়তই কোচিং-স্কুল-প্রাইভেট-কোচিং চক্রে বন্দি। ফলে পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়ার অবসর মিলছে না তাদের। আগে বেশির ভাগ পরিবারে পারিবারিক গ্রন্থাগার ও বাসায় বই পড়ার প্রচলন ছিল। এখন সেটাও কমে এসেছে। এমতাবস্থায়, কেবল জিপিএ-৫ প্রাপ্তির জন্য পড়লেই হবে না, ভালো মানুষ হওয়ার জন্য, সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পড়তে হবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার, ভালো মানের গ্রন্থাগার ও বই পাঠের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে মানুষের মধ্যে বইপ্রীতি বাড়বে।
শিক্ষার্থীদের বইমুখী করতে হলে বাবা-মা ও শিক্ষকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। তাই মা-বাবা ও শিক্ষকেরা বই পড়তে শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করবেন বলেই আমরা প্রত্যাশা করি। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ৩০ মিনিট বই পাঠের একটি ক্লাস থাকতে পারে।
আরেকটি বিষয়, প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি ও অপব্যবহারের প্রভাব জীবনের নানাক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর ফলে সাইবার অপরাধও বাড়ছে। বই পড়ায় প্রভাব তো পড়ছেই। অনেক শিক্ষার্থীকে শেষের কবিতা, দুই বিঘা জমি কিংবা বনলতা সেন কবিতার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, এসব কবিতার কথা তারা কখনো শোনেনি। এটি দুঃখজনক বিষয়।
সমৃদ্ধশালী জাতি গড়ে তুলতে হলে বই পাঠের বিকল্প নেই। সুতরাং মনের উৎকর্ষতা লাভের জন্য বই পড়া বাড়াতে হবে। মনের উৎকর্ষতা লাভ হলেই একজন মানুষ মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন প্রকৃত মানবে পরিণত হতে পারে। সেজন্য প্রযুক্তির অপব্যবহার দূর করতে হবে সর্বাগ্রে। মোটকথা, এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে। বই পড়া আর পাঠাগার স্থাপনে আগ্রহ বাড়াতে হবে। এবং ছোটদেরও উৎসাহিত করতে হবে বেশি বেশি বই পড়তে।