ঘটনাটি ঘটিয়াছে গত রবিবার। এই দিন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের ছেলের বউভাতের অনুষ্ঠান ছিল। এই অনুষ্ঠানে একযোগে অংশগ্রহণ করেন কুড়িগ্রামের তিন উপজেলা—রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারীর সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। সেইখানে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারাও। বিস্ময়ের ব্যাপার হইল, এই বউভাত অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে এই তিন উপজেলার ২৬৫টি স্কুলে এই দিন ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি। স্কুলে আসিয়া অনেক শিক্ষার্থী পাঠদান বন্ধ দেখিয়া হতাশ হইয়া বাসায় ফিরিয়া যায়। এই ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য তিনটি উপজেলার এতগুলি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখা লইয়া দেশব্যাপী তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠিয়াছে। এমন কাজ স্কুল কর্তৃপক্ষ করিতে পারেন কি না, তাহা ভাবিয়া দেখিবার বিষয়।
সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন বলা হইতেছে, বউভাতের জন্য নহে, বরং প্রচণ্ড শীতের কারণে প্রধান শিক্ষকগণ তাহাদের ক্ষমতা বলে এমন ছুটি দিয়াছেন। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা এমন কঠিন পরিস্থিতিতে প্রধান শিক্ষকগণ ইচ্ছা করিলে বত্সরে তিন দিন ছুটি দিতে পারেন। সেই সংরক্ষিত ছুটি হইতে এক দিনের ছুটি দেওয়া হইয়াছে। বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষা বিভাগ অবহিত বলিয়াও দাবি করা হয়। এই অনুষ্ঠানে ১ হাজার ৩০০ শিক্ষক আমন্ত্রিত ছিলেন। এই জন্য তাহাদের নিকট হইতে ৫০০-৮০০ টাকার চাঁদা উত্তোলন করা হয়, যাহা দ্বারা উপহার স্বরূপ ক্রয় করা হইয়াছে সোনার আংটি, রেফ্রিজারেটর ও ওয়াশিং মেশিন। কেহ কেহ মিষ্টিও উপহার দিয়াছেন। প্রতিমন্ত্রী এই তিন উপজেলা লইয়া গঠিত কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সম্মানিত সংসদ সদস্য। তাহা ছাড়া তাহার একমাত্র ছেলের বিবাহ বলিয়া কথা। তিনি এই জন্য ধুমধাম করিয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করিতেই পারেন। তাহাতে নিজ নির্বাচনি এলাকার মানুষকে জানাইতে পারেন আমন্ত্রণও। ভোটের রাজনীতির বিবেচনায়ও বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। রাজনীতি যাহারা করেন তাহাদের যেমন নিজ এলাকায় ঘন ঘন অন্যের দাওয়াত গ্রহণ করিতে হয়, তেমনি সাধারণ মানুষকেও তাহার দাওয়াত দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। ইহাতে দোষের কিছু নাই। আবার যাহারা সেই বউভাতে হাজির হইয়াছিলেন তাহারাও কোনো গর্হিত কাজ করিয়াছেন বলিয়া আমরা মনে করি না। কেননা একজন মুসলমান মাত্রই আরেক মুসলিম ভাইয়ের দাওয়াত রক্ষা করিবেন, ইহাই ধর্মীয় নিয়ম। অর্থাৎ এইখানে দাওয়াত প্রদান ও গ্রহণকারী উভয়কে দোষারোপ করিবার কোনো অবকাশ নাই; কিন্তু যেই সকল শিক্ষক দাওয়াতে গেলেন তাহারা তাহাদের দায়িত্ব পালন করিয়াই যাইতে পারিতেন। এই জন্য স্কুল বন্ধ রাখিতে হইবে কেন? ইহাতে অতি উত্সাহী ও তৈলবাজ মহলের বিশেষ ইন্ধন থাকিতে পারে। প্রতিমন্ত্রীর এলাকার শিক্ষকরা তাহাকে খুশি করিতে গিয়া এমন কাজ করিয়া থাকিতে পারেন বলিয়া আমাদের প্রতীয়মান হয়। আবার অনুষ্ঠানের আয়োজকদেরও উচিত ছিল শিক্ষকদের জন্য এমনভাবে নিমন্ত্রণের সময় নির্ধারণ করা, যাহাতে তাহারা স্কুলের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করিয়াই সেখানে উপস্থিত হইতে পারেন। আর যদি জোরজবরদস্তি না থাকে, তাহা হইলে যে কেহ যাহাকে খুশি উপহারসামগ্রী দিতে পারেন। তবে বিবাহশাদি, সুন্নতে খাত্না ইত্যাদি উপলক্ষ্যে উপহারসামগ্রী প্রদান করা ইসলাম সমর্থন করে না। কেননা এইখানে দোয়া বা শুভকামনাই বড় কথা।
আমাদের বক্তব্য হইল, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পূর্বাপর অনেক কিছু বিবেচনা করিয়াই পা ফেলা প্রয়োজন। কেননা তাহাদের বেতন-ভাতা আসে হতদরিদ্রদেরও প্রদত্ত করের টাকা হইতে। তাহারা তাহাদের কথা চিন্তা না করিয়া, নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করিয়া এবং কোনো প্রকার অজুহাত তৈরি করিয়া নিজেদের এই দায়িত্ব অবহেলার পরিচয় দিতে পারেন না। এখানে জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপারেও আমাদের কিছু বলিবার আছে। প্রায়শ দেখা যায়, তাহারা নিজ সংসদীয় এলাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সভা-সমাবেশে ব্যবহার করিয়া থাকেন। তাহাদের সংবর্ধনা দিতে অনেক সময় তাহাদের রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়া রাখা হয়। এই সকল দৃষ্টিকটু আচরণ হইতে যেমন বিরত থাকা উচিত, তেমনি বিতর্ক সৃষ্টি করিতে পারে, এমন যে কোনো কর্মকাণ্ড হইতেও তাহাদের শত গজ দূরে থাকা প্রয়োজন।