সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছয় জনের এখন পর্যন্ত ফাঁসি হয়েছে। বাকি আছেন আরো পাঁচ জন। তারা হলেন আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী এবং এ বি এম এইচ নূর চৌধুরী। রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন? বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ তাদের ফেরত পাঠাতে বিভিন্ন সময়ে আবেদন জানালেও দেশ দুটির সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি? অন্যদিকে আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন কোথায় আছেন, সেই খোঁজ এখন পর্যন্ত পায়নি সরকার।
খুনিদের ফিরিয়ে আনার অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘দুটোর খবর জানি, তিনটার কোনো খবর জানি না। যে দুজনেরটা জানি, তাদের ফেরানোর কোনো আপডেট নাই।’ তিনি জানান, আমেরিকা আমাদের সরকারকে নতুন করে কোনো তথ্য দেয়নি। অন্যদিকে কানাডা এখন পর্যন্ত কোনো তথ্যই দেয়নি। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, সরকার এ ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘যারা সর্বোচ্চ আদালত থেকে সাজাপ্রাপ্ত, তাদের মধ্যে যাদের ব্যাপারে এই রায় এখনো কার্যকর করা যায়নি, তারা পলাতক থাকার কারণে এবং দুজন দুটি দেশে থাকার কারণে তাদের ফিরিয়ে এনে এই রায় কার্যকর করার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।’
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিলের রায়ে তিন জন খালাস পান। বাকি ১২ জনের মধ্যে আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান বলে খবর বের হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকার কারাগারে। সে সময় পলাতক ছিলেন ছয় জন। ১০ বছর পর ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতকদের একজন ৭২ বছর বয়সি মাজেদকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বাকি পাঁচ জনের এক জন রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ভারতে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছেন এমন সংবাদ বের হলেও তার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তার ব্যাপারে একটা খবর এসেছিল। আমরা এটা যাচাই-বাছাই করে দেখেছি, এখন পর্যন্ত এর সত্যতা আমরা পাইনি।’
যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত সে দেশের সরকারের পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়ার খবর গত বছর প্রকাশিত হয়েছিল। দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের এই উদ্যোগে সেখানে তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিলের সম্ভাবনা তৈরি হয়। তবে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে ঐ পর্যন্তই আছে, তারা কাগজপত্র দেখছেন। ওদের আমরা বললে বলে, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস স্বাধীন। তারা দেখবে বিষয়টা।’
এদিকে কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেছে সরকার। তবে আইনি জটিলতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। দেশটির আইনে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ। অন্য দেশের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকেও তাই তারা ফেরত পাঠাতে পারে না। দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী ক্যারিনা গোল্ডের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকেও নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গ তোলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশ এখনো হাল ছেড়ে দেয়নি। দুই খুনিকে ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘আমরা সরকারকে বলছি, খুনিদের ফেরত দাও। যেহেতু তোমরা সুশাসনের কথা বলো, আইনের শাসনের কথা বলো, আমরা আমাদের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সুশাসন নিশ্চিত করতে চাই, এ কারণে তোমরা খুনিদের ফেরত দাও।’ তিনি দেশ দুটিকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেন, ‘তোমাদের দেশকে আমরা ‘হাব ফর কিলারস’ (খুনিদের আশ্রয়স্থল) হিসেবে দেখতে চাই না। এটা তোমাদের জন্য লজ্জার।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী রশীদ ও ডালিম। তবে বহুদিন ধরেই তাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই জানা যাচ্ছে না। পুলিশ সদর দপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, তাদের ‘অবস্থান শনাক্তকৃত নয়’? তবে ডালিমের ‘সম্ভাব্য অবস্থান’ পাকিস্তান কিংবা লিবিয়া আর রশীদের ‘সম্ভাব্য অবস্থান’ লিবিয়া কিংবা জিম্বাবুয়ে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বলছে, পলাতক খুনিদের আনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের সবার নামেই ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি আছে। দুই খুনিকে ফেরাতে এবং অন্যদের অবস্থান চিহ্নিত করতে প্রবাসীদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে কোনো তথ্য নাই। এত লোক বাইরে থাকে, কিন্তু দুষ্টলোকের খোঁজ দেয় না। আমরা তাদের অ্যাওয়ার্ড দেব বলেছি, তবু তারা দেয় না।’
এমতাবস্থায় প্রবাসী ভাইবোনদের উচিত অন্তত প্রতি মাসে একবার এই খুনিদের বাড়ির সামনে গিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা। আর স্থানীয় জনসাধারণকে এ কথা বলা যে, এখানে খুনি থাকে, যাতে তারা পীড়িত হয়। আমরা আশা করি, বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং একদিন তাদের ফাসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে এই বাংলার জমিন সম্পূর্ণভাবে কলঙ্কমুক্ত হবে।