এখন জাতির নানা সংকটে পদে পদে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার মহৎ গুণকে স্মরণ করি আর আফসোস হয় এ জাতি বেশিদিন তাঁকে পেল না। কুলাঙ্গাররা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার এই মহানায়ককে বাঁচতে দিল না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে ক্রমাগত যখন কালো ছায়া ঢেকে ফেলছে, তখন বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা বড় হয়ে দেখা দেয়। সদ্যঃস্বাধীন দেশে হাজার সংকটের মোকাবেলা করতে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুকে।
তবু তিনি শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বিলম্ব করেননি। এখনকার ক্ষমতাসীনরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনীতির খোঁয়াড়ে পরিণত করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরির সম্ভাবনাকে কবর দিচ্ছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু জ্ঞানচর্চার তীর্থকেন্দ্র পরিচালনায় জ্ঞানী পণ্ডিতদের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেছিলেন। এখনকার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উগ্র রাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে বদ্ধ পুকুর বানাতে চাননি। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন জ্ঞানচর্চার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তাঁর শিক্ষাভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন মুক্তবুদ্ধিচর্চার ভূমিতে স্বাধীন পারিপার্শ্বিকতা প্রয়োজন। তাই ১৯৭৩ সালেই অধ্যাদেশ জারি করে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এর আওতায় নিয়ে এলেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এখন এই গণতান্ত্রিক কাঠামোকে রাজনৈতিকীকরণের যন্ত্রে ফেলে অপব্যবহারের চূড়ান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে পাণ্ডিত্যকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা-ই নয়, তিনি দেশবরেণ্য পণ্ডিতদের মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের কথাও ভেবেছিলেন।কিন্তু আজ আমাদের ক্ষমতার রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় উগ্র রাজনৈতিকীকরণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনাকে লাঞ্ছিত করে এখন লাইফ সাপোর্টে এনে ফেলে দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ—সর্বত্র রাজনৈতিক পরিচয়টি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। দলীয় ছাত্রসংগঠনের উন্মত্ততা একটি দম বন্ধ পরিবেশের পথ রচনা করছে। শিক্ষকদের একটি অংশ জ্ঞানচর্চার চেয়ে রাজনীতি চর্চা করে সুবিধার পেছনে ছুটছে।
আমি জানি না, আমাদের মতো মনঃকষ্টে আর কারা আছেন। এখানে ‘আমরা’ বলতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের কথা বলছি। ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবার কথা। কারণ আমরা কাছে থেকে দেখছি জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির তপোবন বিশ্ববিদ্যালয় কেমন অনুর্বর ঊষর মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময় শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে এসেছিলাম। ফুফাতো ভাই রেলওয়েতে চাকরি করছেন। খুব গর্ব করে বললেন, তাঁর বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই শিক্ষককে আমি কোনো দিন দেখিনি, কিন্তু সেই মুহূর্ত থেকে আমার কাছে আমার এই ভাইটির মর্যাদা অনেক বেড়ে গেল। সোজা কথা নয়, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর বন্ধু। আমি যখন ছাত্র এবং শিক্ষকতায় যোগদান করি, ওই সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। এর অনেক আগে উপাচার্য ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান ও মুহম্মদ এনামুল হকের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিতজন। উপাচার্য পদের সঙ্গে এসব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উজ্জ্বল নক্ষত্র মানিয়ে গিয়েছিলেন। ভালো যে তখন রাজনৈতিক নিয়োগের যুগ শুরু হয়নি। না হলে জানা হতো না অমন বিশাল মাপের পণ্ডিতজনরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন এবং সৌন্দর্য ছড়িয়ে ন্যায়দণ্ড হাতে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন। আমার সৌভাগ্য যখন শিক্ষকতা পেশায় আসি, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কু-রাজনীতি গ্রাস করেনি। তাই নিজ যোগ্যতার গুণে আর উপাচার্য এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে আমার আবাল্যের স্বপ্ন পূরণ করে অনায়াসে শিক্ষক হতে পেরেছিলাম। যেহেতু ছাত্রজীবনে রাজনীতি করার কোনো সিলমোহর গায়ে পড়েনি, যেহেতু আমার বড় কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা মন্ত্রী-এমপি তদবিরকারী নেই এবং যেহেতু শিক্ষক হওয়ার জন্য টাকা ছড়ানোর রুচি ও ক্ষমতা কোনোটাই নেই, তাহলে আজ কোথায় ভেসে যেতাম কে জানে!
আজ সব কিছু দেখে দারুণ হতাশার মধ্যে দাঁড়িয়ে অসংকোচে বলব, জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ—সব দলের ক্ষমতাসীনরা যাঁর যাঁর ক্ষমতাকালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্ষমতার অন্যতম হাতিয়ার বানাতে গিয়ে বিদ্যাপীঠকে যেভাবে ধ্বংস করেছেন, করে যাচ্ছেন, এর জন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায় সবাইকেই একদিন দাঁড়াতে হবে। কিন্তু ততক্ষণে জাতির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। হয়তো ব্যতিক্রম আছে, তবু সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে মেধাবী ফলাফল, গবেষণার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি এখন আর প্রধান বিষয় নয় বা জরুরি বিষয়ও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতিতে অভিজ্ঞ একজন ক্ষমতাবান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলছিলেন একজন সহকর্মী। তাঁর মেধাবী মেয়েটি সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ করেছে। ফল বরাবরই ভালো। এখন গ্রেড সিস্টেম। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়ার ব্যাপার নেই এখন। তবু অনার্স-মাস্টার্সে যে নম্বর পেয়েছে, তাতে ফার্স্ট ক্লাসের সমতুল্য। তবু ০.২, ৩, ৫ নম্বর বেশি পেয়ে আরো তিন-চারজন শিক্ষার্থী মেয়েটির ওপরে আছে। অধ্যাপক সাহেবের ইচ্ছা তাঁর মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হোক। তিনি তাঁর দুর্ভাবনার কথা রাজনীতি করা সহকর্মীকে জানালেন। আমাদের জাঁদরেল অধ্যাপক হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি তো দেখছি আপনার মেয়ের সম্ভাবনাই বেশি উজ্জ্বল। এখন ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া মেধাবীরা বিশেষ পাত্তা পায় না। পাত্তা পাওয়ার হিসাবটা অন্য। ’
আমি মনে করি, কঠিন সত্যটি বলে ফেলেছেন অধ্যাপক বন্ধু। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মী দুঃখ করে বলছিলেন, ‘বিশেষ প্রয়োজনে উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বেশ বিব্রত হতে হয়। তাঁর অফিস রুমে গিয়ে দেখতে হয় আগে থেকেই চেয়ার দখল করে ছাত্রলীগের নেতারা চায়ের কাপে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। ’ আমার মনে পড়ে গেল আমার ছাত্রজীবন ও শিক্ষকজীবনের প্রথম দিকটার কথা। তখন উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সামনে আমাদের মাথা অবনত থাকত। প্রাক-অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাত্রজীবন ও শিক্ষকজীবনের প্রথম দিকটার কথা। তখন উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সামনে আমাদের মাথা অবনত থাকত। প্রাক-অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করার প্রশ্নই ছিল না। ছাত্রনেতাদেরও সময়ে-অসময়ে অনুমতি ছাড়া উপাচার্যের অফিসে যাওয়া তো ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। বিষয়টি অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। তবে আমি মনে করি, ন্যায়ানুগভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান ও আচরণ মানার দরকার আছে।
আমাদের উজ্জ্বল মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। শাণিত মেধার শিক্ষার্থীরাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। সেই স্বপ্ন নিয়েই নিজেকে প্রস্তুত করে অনেকে। কিন্তু খুবই কষ্টের মুখোমুখি হই, যখন আমার তেমন ঝকঝকে ছাত্র-ছাত্রী অথবা কারো রেফারেন্সে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধাবী ফলাফল করে আসা ছাত্র-ছাত্রীটি বলে, ‘স্যার, অমুক বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিয়েছে, আমি আবেদন করেছি। ’ সঙ্গে যখন এই কথাটিও জানায়, ‘যতটুকু জেনেছি আবেদনকারীদের মধ্যে শিক্ষা পর্যায়ের সব ফলাফল ও গবেষণার বিচারে আমি এগিয়ে আছি’। তখন আরো বেশি বিপন্ন বোধ করি। আমি খুব সতর্কভাবে জানার চেষ্টা করি ছাত্রজীবনে ওরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল কি না, যদিও জানি এমন মেধাবীরা আজকাল সাধারণত ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে না। এ ক্ষেত্রেও না-বোধক উত্তর আসে। জানার চেষ্টা করি উপাচার্য বা প্রশাসনঘনিষ্ঠ রাজনীতি করা শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি না। সেখানেও যদি না-বোধক উত্তর আসে, তখন শেষবারের মতো জানতে চেষ্টা করি কোনো ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা বা ডাকসাইটে মন্ত্রী তদবির করতে পারবেন কি না, সেখানেও যদি উজ্জ্বল মেধাবী শিক্ষার্থীরা মাথা নিচু করে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে, তখন আমি ওদের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভীষণ বিব্রত বোধ করি।
সব কিছুর পরও আমি যেহেতু শিক্ষক, তাই ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে আমাকে তাকাতেই হয়। অনেক যত্নে যেসব মেধাবী শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি, ওদের বিপন্ন চেহারার দিকে তাকাতে পারি না। ওরা কি আর কখনো কোনো সুস্থ পরিবেশ পাবে না, যেখানে শিক্ষক নিয়োগ শুধু মেধার মূল্যায়নে হবে, যে পরিবেশ আমাদের শিক্ষক হওয়ার সময়ে ছিল। আমি কি আর মনের জোর নিয়ে আমার ছাত্র-ছাত্রীদের বলতে পারব না লেখাপড়া আর মেধাচর্চায় নিজেকে যোগ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসো। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে নিজেকে প্রস্তুত করো। এই সময়ের বাস্তবতায় আমি শুধু বিপন্ন দৃষ্টি নিয়ে এসব দুর্ভাগা শিক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি, তাহলে এসব মেধাবী যাবে কোথায়! এক পারি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে, যাতে ক্ষমতাবানদের মনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা জাগে।
প্রতিদিনই খবর বের হয়, বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আর হলও নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী মানসিকতার ছাত্র-ছাত্রী নামধারীরা, যাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের কার্যত ক্ষমতা নেই শিক্ষকদের। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ করা উপাচার্য ও প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ওদের ঘাঁটাতে চান না। প্রয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। এমন বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা লাঞ্ছিত হবেই। এভাবে বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত অনুসারীদের হাতেই বিপর্যস্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা লাইফ সাপোর্টে চলে যাচ্ছে।