১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে পদার্পণ করেন, যে দিনটি ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে উল্লিখিত। এ কথা অবধারিত যে, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এ কারণে আমাদের জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিনে তিনি এক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। যে ভাষণে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনসহ নানা নির্দেশনা সংবলিত দার্শনিক ভাবধারায় উপস্থাপন করেন তার জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মূল্যবোধ। বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল অবহেলিত ও শোষিত বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা, যার মধ্য দিয়ে বাঙালি তার আত্মমর্যাদা ফিরে পাবে। সেই স্বপ্ন তার পূরণ হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেই যে আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার ভাষণের একাংশে তিনি বলেন, ‘আমার বাঙ্গালী আজ মানুষ হয়েছে।’ এই বক্তব্য বাঙালি জাতির জন্য দর্শন সংবলিত এক অভাবনীয় বক্তব্য। বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, এখানে মানুষ অর্থ হলো প্রকৃত মানুষ। যে মানুষ অধিকারসচেতন, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল, সাহসী, সংগ্রামী, মন ও মননে আপসহীন। এই মানুষই সব ক্ষমতার উত্স। যেমনটি বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন গণতান্ত্রিক দেশে জনগণই সব ক্ষমতার উত্স। প্রসঙ্গক্রমে এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ‘ব্রেইনচাইল্ড’ ৬ দফা প্রদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ওপর আস্থা অর্জন করেছিল। একইভাবে বঙ্গবন্ধুও সমগ্র বাঙালির প্রতি ছিলেন আস্থাশীল, যার ঐতিহাসিক প্রমাণ ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা আর ’৭০-এর নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন। নেতার প্রতি জনগণের আস্থা আর জনগণের প্রতি নেতার আস্থা অর্জনের ঐতিহাসিক এই ঘটনাপ্রবাহ যেমন :’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঘোষণা’, ’৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় লাভ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঐতিহাসিক এই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস তরুণ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কেননা, তরুণ প্রজন্মের কাছে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের সঠিক তথ্য সঞ্চালন বর্তমান সময়ে জরুরি হয়ে পড়েছে। আজ স্বাধীনতার ৫১ বছর পার করছে জাতি। এই বাংলাদেশের জনসাধারণের একটি বড় অংশই তরুণ প্রজন্ম। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। ফলে তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল এবং যুদ্ধ-পূর্ব আন্দোলন-সংগ্রাম আর যুদ্ধোত্তর ঘটনাপ্রবাহ ঐতিহাসিক গুরুত্বে সঞ্চারিত করা আবশ্যক। কেননা, যুদ্ধ-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে ভুল তথ্যে ষড়যন্ত্রমূলক উপস্থাপনে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা এর আগে বিদ্যমান ছিল। যে কারণে বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা—এই আবর্তে সঠিক ইতিহাস সঞ্চারিত করতে সংশ্লিষ্ট সব ঐতিহাসিক ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব এবং মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর সঠিক ইতিহাস ও ঘটনাবলি তরুণ প্রজন্ম যখন সঠিকভাবে জানবে, তখন বর্তমান তরুণ প্রজন্ম নিজেরাই নিজ বিবেচনাপ্রসূত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। এছাড়া সঠিক ইতিহাসের আলোকে তরুণ প্রজন্মের মননে সঠিক প্রেরণা গ্রথিত হবে, যা তাদের আত্মসচেতনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর এ বিষয়গুলোর সমন্বয়ে গড়ে উঠবে ত্যাগের মহিমা, উদ্বুদ্ধ হবে দেশপ্রেমের আবর্তে দেশ গড়ার প্রত্যয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে এ কথা বলা প্রয়োজন, বর্তমানে বাংলাদেশ সমন্বিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্পায়ন, সড়কযোগাযোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণ, শিক্ষাব্যবস্থায় অমূল পরিবর্তনসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্থানীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা, আবাসনসহ প্রায় প্রতিটি খাতভিত্তিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি এখন দৃশ্যমান। আর এই অগ্রগতি চলমান ও গতিশীল করতে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক তরুণ প্রজন্মের যথাযথ অবদান নিশ্চিত করা। আর এই অবদান নিশ্চিত করতেই উল্লিখিত সঠিক ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ তরুণ প্রজন্মের মন ও মননে সঞ্চারিত করতে হবে, যেখানে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ ইতিহাসের আলোকে গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। সুতরাং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব, ১৩ বছরের অধিক জেলজীবন, মুক্তিযুদ্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, যুদ্ধবিধস্ত দেশের পূর্ণগঠনে নানামুখী উদ্যোগ তরুণ প্রজন্মকে সঠিকভাবে অবহিত করার মধ্য দিয়ে বিকৃত তথ্য, ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি ভ্রান্ত ইতিহাসের অবলুপ্তি ঘটবে। তাদের পরিচয় ঘটবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, উন্নয়ন দর্শন, শিক্ষা দর্শনসহ সমন্বিত দার্শনিক মূল্যবোধের সঙ্গে। সংগত কারণেই এই সমন্বিত দার্শনিক মূল্যবোধের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে তরুণ প্রজন্মের মন ও মননে, যা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে অতীব প্রয়োজনীয়।
অতএব, এই প্রয়োজন সামনে রেখে আগামীর বাংলাদেশকে বিশ্বের মাঝে উন্নত বাংলাদেশ তথা আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি জাতির স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সমগ্র বাংলাদেশের সব প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধভাবে অবদান রাখতে হবে। আর তাহলেই এই দেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাবে। আর এর জন্য প্রয়োজন প্রকৃত আদর্শবান মানুষ। যে মানুষের কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।