সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তায় ও মননে পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে প্রতিনিয়ত। সময়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, উদ্ভূত ঘটনাবলি, আর সমসাময়িক কর্মকাণ্ড সরাসরি প্রভাবিত করে মানুষের চিন্তা ও মননে। সে প্রভাব ইতিবাচক না নেতিবাচক, সে প্রভাব সঠিক না ভুল, সে প্রভাব সংগঠিত না বিচ্ছিন্ন তা বিচার্য বিষয়। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ যে জঘন্য হত্যাযজ্ঞ হয়েছে তাতে বাংলাদেশের মূল আদর্শে আঘাত হেনেছিল।
মূলত বিপরীত দিকে ধাবিত হয়েছিল ভুল তথ্য আর বিকৃত ইতিহাস সঞ্চালনের জঘন্য ষড়যন্ত্র দিয়ে। যে ক্ষত স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসেও রয়ে গেছে। এখনো চলছে মিথ্যা তথ্য ও বিকৃত ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র। এই অবস্থা থেকে সঠিক উত্তোরণের প্রচেষ্টা এখন গুরুত্ববহ। এখনো প্রজন্মের পর প্রজন্মের মন ও মননে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রভাবে নিজ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সঠিক ইতিহাস ও নেতৃত্বের ভূমিকায় ভুল তথ্যের ও বিকৃত ইতিহাসের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে আছে কিয়দাংশ। আর এই ভুল তথ্যে কিছু অংশ মানুষের মন ও মননের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হতে যাচ্ছে আরো কিছু তরুণ প্রজন্ম। সংকট এখানেই। উত্তোরণের পথও আছে। শুধু প্রয়োজন যথাযথ প্রচেষ্টা। ১৯৭১-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন তা হঠাৎ করে নয়।
১৯৭১ পূর্ববর্তী ইতিহাসে দেখা যায়, সেই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধিতে এসেছিল যে, জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের কারণে যে পাকিস্তান হলো তা যথাযথ হয়নি। তার প্রমাণও পাওয়া গেল ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ’র রাষ্ট্রভাষা উর্দু প্রচলনের ঘোষণায়। ফলে বাঙালি জাতিসত্তায় যে আঘাত হেনেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা সবাই উপলব্ধি করতে শুরু করল। ১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যে আত্মত্যাগ আরো প্রমাণ জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ ভুল। বঙ্গবন্ধু যেটা আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। এই আত্মোপলব্ধির কারণেই তিনি ৬ দফা দিয়েছিলেন, যা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার জনগণকে স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই ৬ দফার মধ্যে দিয়েই সমগ্র বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিলেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করার ঘটনায়। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুও বাঙালির ওপর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এক অর্থে শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি পেয়েছিল।
যা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ আছে। আর এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু যে আপামর বাঙালি জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন তার আর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। লাখ লাখ জনগণ সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আর ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা ২৫শে মার্চের গণহত্যার অব্যবহিত পরে। সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে এদেশের আপামর মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ আর লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের ত্যাগের মহিমা আজ ইতিহাস। এছাড়া শত শত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবী, শ্রমিক, কৃষক, যুবক, নারী নানাবিধ অত্যাচার, নির্যাতন, জেলজুলম, সহ্য করে নেতৃত্ব দেন যার পুরোধা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সুতরাং মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে স্বাধীনতা অর্থাৎ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তা বাঙালির আত্মত্যাগের প্রতিফলন। প্রসঙ্গত সামগ্রিক এই ঘটনাপ্রবাহে উল্লেখ করতে হয় যে, আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু, মহান মুক্তিসংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ আর তার ফলাফল স্বাধীনতা এই তিনটি বিষয়ই একই আবর্তে গাথা। ফলে উল্লিখিত নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু, সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ আর সার্বভৌম বাংলাদেশ এর স্বাধীনতা ইতিহাসের এক অকাট্য প্রামাণ্য। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ইতিহাসের এই যথার্থতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে বিকৃত করা হয়েছে। যা মানুষের মন ও মননে কিয়দাংশ হলেও প্রভাবিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সামগ্রিক উপস্থাপনে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইতিহাসের ও তথ্যের সঠিকতা সঞ্চালনে নেতৃত্বের ওপর জনগণের আস্থা আর নেতার জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ এবং স্বাধীনতার ফলাফল সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর মাঝে বাঙালি জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত। সঙ্গত কারণেই ধ্রুবসত্য এই ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করা সমগ্র বাংলাদেশের নাগরিকের নৈতিক কর্তব্য। যা জনগণের মন ও মননে সুগঠিত রূপে স্থায়ী হবে।
সেখানে কোনো বিকৃত তথ্য ও বিভ্রান্ত ইতিহাসের স্থান থাকবে না। অতএব বাঙালি জাতিরাষ্ট্র এই বাংলাদেশ এবং তার নাগরিকের মন ও মননে শত বছরের সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠা পাবে নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু, সংগ্রামে মহান মুক্তিযুদ্ধ আর সার্বভৌম বাংলাদেশে স্বাধীনতা। জনগণের মন ও মনন কখনোই প্রভাবিত হবে না সত্য এই ইতিহাসের বাইরে অন্য কোনো ভুল তথ্যে ও বিকৃত ইতিহাসে। সময় এগিয়ে চলবে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাবে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মাঝে। আর বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের বাংলাদেশের নাগরিক আত্মমর্যাদাশীল নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করবে অদূর ভবিষ্যতে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন আর রূপকল্প-২০৪১ এর কর্মপ্রক্রিয়ার আলোকে ২১০০ সালের ডেলটাপ্ল্যান লক্ষ্যমাত্রার মধ্যদিয়ে।