গত এক দশকে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। রাজধানী থেকে জেলা-উপজেলা, এমনকি গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় তথ্যপ্রযুক্তিসেবা পৌঁছে দিয়েছে বর্তমান সরকার। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সহযোগী হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরশেন সার্ভিসেস (বেসিস)। এই খাতে বাংলাদেশের উন্নতি প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সার্ভিসেস অ্যালায়েন্সর (উইটসা) মহাসচিব জেমস পয়জ্যান্টস বলেছেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ অনেক ভালো করছে এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই উইটসা ঢাকাকে বেছে নিয়েছে বিশ্ব সম্মেলনের জন্য।’ বর্তমানে দেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে আয় ১০০ কোটি ডলার। ২০২২ সালে এই আয় ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার প্রযুক্তির বিকেন্দ্রীয়করণ করছে। এজন্য দেশব্যাপী ২৮টি হাইটেক পার্ক করা হয়েছে। নতুন দশকের শুরুতেই ফাইভ-জি প্রযুক্তি জনগণের কাছে চলে আসবে। এই প্রযুক্তির হাত ধরেই আসবে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, রোবোটিকস ও বিগ ডেটা অ্যানালাইসিসের মতো নানা কাজ। এজন্য প্রয়োজন হবে দক্ষ কর্মীর।
আগামী একদশকের মধ্যে আরো নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এসে নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে জানিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। আগামী দশকে প্রায় ১ লাখ দক্ষ কর্মী তৈরি করতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। জেনেক্স ইনফেসিস, সিনেসিস আইট, ব্রেইনস্টেশন, ইক্সোরা, বিজেআইটি, প্রাইডসিস, সিসটেক ডিজিটাল, ব্রাক আইটি, মাইসফট, মিডিয়াসফট, ইরা ইনফোটেক, নেসেনিয়া, টিকন, পিপপল এন টেক, এনআইটিএস, বিভিক্রিয়েটিভস, টেকনোভিস্তা, আমরা টেকনোরজিস, বি-ট্র্যাক টেকনোলজিস, এডিএন, এডিএন টেকনোলজিসের মতো আধুনিক প্রতিষ্ঠান ধরনের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করছি আমরা। পুরোনো পণ্যসেবাগুলোর জায়গায় হালনাগাদ পণ্যসেবা দ্রুত চালু করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় স্মার্টফোনের সক্ষমতা, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ক্লাউড কম্পিউটিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রিয়েল-টাইম স্পিচ রিকগনিশন, ন্যানো কম্পিউটার, ওয়্যারেবল ডিভাইস ও নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন, সাইবার সিকিউরিটি, স্মার্ট সিটিজ, ইন্টারনেট পণ্যসেবা আরো উন্নত হবে। ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের বিকাশ এই দশকে বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির দিগন্ত পুরো পালটে দেবে বা দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এখন থ্রিডি প্রিন্টিং ও বায়োমেটিক চালুর বিষয়ে জোরালোভাবে কথা বলছেন। অনলাইন কার্যক্রমে এখন যেভাবে নতুন নতুন ডিভাইস, কৌশল ও প্রবণতা ব্যাপক হারে চালু ও বিকশিত হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে বাংলার মানুষের লাইফস্টাইল বা জীবনধারাকে আমূল পালটে দেবে। দেশকে ডিজিটাল করে তুলতে হলে প্রশাসন, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিক্ষাসহ সব খাতেই আরো অধিক হারে স্মার্ট মেশিন ও প্রক্রিয়াগত সুযোগ-সুবিধা অর্থাৎ প্রযুক্তির প্রচলন ও ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন।
এদিকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এখন মহাকাশে। ২০২৩ সালে মহাকাশে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২। এটির কার্যক্রম ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২-এর ধরন নির্ধারণে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১ লাখ ৮৫ হাজার ডলারের চুক্তি হয়েছে। কোন স্যাটেলাইটটি বাংলাদেশের জন্য উপযোগী, তা ঠিক করতে পিডব্লিউসি পর্যালোচনা করে তিন মাসের মধ্যে বিএসসিএলকে পরামর্শ দেবে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১২ মে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মূলত একটি কমিউনিকেশন ও ব্রডকাস্টিং স্যাটেলাইট। ইতিমধ্যে এটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম-এর কিউ ব্যান্ডের মাধ্যমে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে। যার মাধ্যমে শহরে থেকে গ্রামগঞ্জে তথা প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিভি ও রেডিও সম্প্রচার পৌঁছে যাচ্ছে। গ্রাহক ছোট একটা অ্যান্টেনা দিয়ে এই সেবা পাচ্ছে। স্যাটেলাইট সি ব্যান্ডের মাধ্যমে ভিডিও সম্প্রচার সুবিধা পাচ্ছে। ভিএসএটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব সুরক্ষিত নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারছে। ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে যে কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব ইন্টারনেট সুরক্ষিত রেখে ব্যবহার করতে পারছে। সি ব্যান্ডের মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় টেলিকমিউনিকেশন ও মোবাইল কমিউনিকেশন সেবা পাচ্ছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসসহ আরো নানা সুযোগ পাচ্ছেন জনগণ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর মাধ্যমে। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি. যেসব লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্যাটেলাইট ও সংশ্লিষ্ট সেবায় স্বনির্ভরতা অর্জন। গবেষণা ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মাধ্যমে যুগোপযোগী ও মানসম্পন্ন স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক স্থাপন, পরিচালনা, সেবা প্রদান এবং স্যাটেলাইট সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই কোম্পানির কৌশলগত উদ্দেশ্যের মধ্যে আছে স্যাটেলাইটের ব্যবহার বাড়ানো, দেশের পরবর্তী স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ, দেশের অনুমোদিত সব ডিটিএইচ সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর আওতায় আনা, দেশব্যাপী এবং প্রয়োজ্য ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক বিস্তৃতীকরণ, আধুনি সুবিধাসম্পন্ন স্যাটেলাইট ও সংশ্লিষ্ট সেবা সম্প্রসারণ, নেটওয়ার্কভুক্ত অঞ্চলে টিভি চ্যানেল সম্প্রচারসেবা প্রদান, দুর্যোগকালীন নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ নিশ্চিতকরণ ও দুর্গম অঞ্চলে টেলিযোগাযোগসেবা নিশ্চিতকরণ এবং স্যাটেলাইট-সংশ্লিষ্ট গবেষণা মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরবর্তী স্যাটেলাইটের কার্যক্রম সম্পাদন করা।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ করা হলে আমাদের স্যাটেলাইট সেবায় ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এর মাধ্যমে কৃষিজমিতে ফসল হবে কি না, তা তিন মাস আগে থেকে বলা যাবে। সাত দিন আগে থেকে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যাবে, যেটা এখন দেওয়া হয় ৪৮ ঘণ্টায়। এছাড়া টেলিমিডিসিন, সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা, বিভিন্ন বাহিনীর গোয়েন্দা তৎপরতা ইত্যাদি আরো উন্নতমানের হবে। আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ মহাকাশে উৎক্ষেপণের অপেক্ষায় রইলাম।