জলবায়ু পরির্বতনের ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ—খরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, ওজোন স্তরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়েই চলেছে । বজ্রপাতে জানমালের, পশুপাখি, মানবজীবনের ক্ষয়ক্ষতি আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বজ্রপাতের সংখ্যা ও মৃত্যুহার বিবেচনায় ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে ‘দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। আজকের দিনে গাছ কেটে বহুতল ভবন নির্মাণ, গাড়ির ধোঁয়া, পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, কলকারখানার ধোঁয়া, যেখানে-সেখানে বছর-ভর নির্মাণকাজ, নদীভরাট চলতে থাকায় অত্যধিক মাত্রায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণে বাতাসে গরম ধূলিকণা বাড়ছে, যা বজ্রপাতের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের মতে, বজ্রপাতের অন্যতম কারণ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায় অন্তত ১২ শতাংশ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বাংলাদেশে মূলত ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর এই ৯ মাস জুড়েই হয় বজ্রপাত। ৮০ শতাংশের বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে কৃষি কিংবা অকৃষি খোলা জমিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীতে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। বজ্রপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে গত ২০১১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৯৫১ জন মানুষের। সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাত বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। আশার সংবাদ, বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে অ্যারেস্টর বা বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বজ্রপাত হতে পারে দেশের এমন হটস্পটগুলোতে বজ্র নিরোধক দণ্ড বসিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। সেজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে ৮ জেলায় বজ্রপাতের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ যন্ত্র স্থাপন করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। যন্ত্রটি সাইরেন বাজিয়ে লাল হলুদ ও নীল রঙের মাধ্যমে বজ্রপাতের সর্তক সংকেত দেয়। এর মাধ্যমে বজ্রপাত ও বজ্রঝড় কোন অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হবে, তা এক ঘণ্টা আগেই জানিয়ে দিতে পারে আবহাওয়া অফিস। জানা গেছে, হাওরাঞ্চলসহ দেশের বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় বসবে বজ্র নিরোধক প্রযুক্তি। প্রাথমিক পর্যায়ে হাওর এলাকার ১৫টি স্থানে বসানো হচ্ছে বজ্রনিরোধক যন্ত্র। দশ মিটার উচ্চতার এই অ্যারেস্টর কৃষিজমি বা খোলা মাঠে ১ কিলোমিটার দূরত্বে বসানো হবে, যা বজ্র ভূমিতে আসতে বাধা দেবে। এতে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যে নেমে আসবে। এগুলো ১০০ মিটার এরিয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা দেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খোলা মাঠে বজ্রপাত হলে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বিদ্যুতায়িত হতে পারে। কেউ যদি বজ্রপাতের লক্ষের কাছাকাছি থাকে তবে ভূমির বৈদ্যুতিক প্রভাবে তার মৃত্যু হতে পারে। তবে গাছের নিচে থাকলে বজ্রপাত ঐ গাছের ওপর দিয়েই চলে যায়। মানুষের প্রাণ বেঁচে যায়। সেজন্য বিশেষজ্ঞরা মানুষকে সচেতন করার ওপরে জোর দিয়েছেন। এসব উদ্যোগের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে হবে। খোলা মাঠের চারপাশে প্রচুর উঁচু গাছ লাগাতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালগাছসহ উঁচুগাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক কোটি তালগাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৩৮ লাখ তালগাছ লাগানোর পর দেখা গেল যত্নের অভাবে গাছগুলোর বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। কাবিখা-টিআর প্রকল্পের আওতায় লাগানো তাল গাছগুলো কোনো কাজে আসেনি। বেশির ভাগ গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলেছে। যদিও তালগাছের চারা রোপণের মাধ্যমে সরকারের কত কোটি টাকা গচ্চা গেছে তার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, কাবিখা প্রকল্পের আওতার মধ্যেই গাছ লাগাতে গিয়ে শত কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। কাগজে কলমে ৩৮ লাখ গাছ লাগানোর হিসাব থাকলেও এখন বেশির ভাগ গাছের হদিস মিলছে না। যাহোক, ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতের বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। বজ্রপাতের মৌসুমে সতর্কতার বিকল্প নেই।