বাংলাদেশ ক্রমশ ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে দেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু ভূমিকম্পের তেমন কোনো পূর্বাভাসের ব্যবস্থা নেই। গত ৯ দিনে তিন বার আর পাঁচ মাসে সাত বার ছোট থেকে মাঝারি আকারের যে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় প্রতিটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের সীমানার ভেতর বা আশপাশে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই ঘন ঘন এ ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এ দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে, যেগুলো বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। আগে হোক বা পরে, এই শক্তি বেরিয়ে আসবেই। আর সেটাই জানান দিচ্ছে এই ছোট ভূমিকম্পগুলো। এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় আকারের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস।
ভূমিকম্পের এমন ঝুঁকি থাকলেও মোকাবিলার প্রস্তুতি অনেকটাই কম। বহু পুরোনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সঠিক সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে, যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া একটি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির লক্ষণ। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে সিলেটসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে ভূমিকম্পের সময়ে কী করতে হবে, তার মহড়া দেওয়া শুরু করতে হবে। ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি ও মহড়াকে নিয়মিত চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
উল্লেখ্য, গতকাল রবিবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে ঢাকা ও এর উত্তরের কয়েকটি জেলায় হালকা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ২, যা মাত্রা অনুযায়ী হালকা ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয়। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলে। এ নিয়ে গত ৯ দিনে তিন বার দেশে ভূমিকম্প অনুভূত হলো। এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর সিলেট এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত। তার আগে ৯ সেপ্টেম্বর আরেকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসামের কাছাড় এলাকা। গত আগস্ট মাসে দুই দফায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে একটি হয় ২৯ আগস্ট। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট। এর আগে ১৪ আগস্ট আরেক বার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্রস্থল ছিল সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়। তার আগে গত ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪৯ মিনিটের দিকে একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ঐ ভূমিকম্পে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকা কেঁপে ওঠে। মাত্রা রিখটার স্কেলে ছিল ৫ দশমিক ৫, যা মাঝারি মাত্রার একটি ভূমিকম্প। আর এর উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়। গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। গত ১৬ জুন রাজধানীসহ সারা দেশে ৪ দশমিক ৫ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ। চলতি বছরের ৫ মে আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এটিরও গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। জাতিসংঘ বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা একটি। এছাড়া বাংলাদেশ পৃথিবীর ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত বিধায় প্রাচীনকাল থেকে এ দেশে মাঝে মধ্যে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। উপরন্তু হিমালয় রেঞ্জ হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। যদিও সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের জনগণ শক্তিশালী ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়নি। গবেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ইন্ডিয়ান, ইউরোপিয়ান এবং বার্মিজ—এ তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। আর এগুলোর মধ্যে সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের ভূঅভ্যন্তরে যে শক্তি সঞ্চিত হয়েছে তা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সাম্প্রতিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, দেশে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বেশি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে মানিকগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, চট্টগ্রাম, মহেশখালী, রাঙ্গামাটিসহ বেশ কয়েকটি স্থানে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এসব লক্ষণ দেখে ভবিষ্যতে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় (২০২১-২০২৫) বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে সারা দেশে ৬ কোটি ১২ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়বে। ১১ লাখ ৯ হাজার পাকা ভবন, ২১ লাখ ১৪ হাজার সেমিপাকা স্থাপনা, ৪০২টি খাদ্যগুদাম, ১৪টি গ্যাস ফিল্ড, ১৯৫টি হাসপাতাল। ১ হাজার আটটি কল্যাণকেন্দ্র, ২ হাজার ৮০০ উচ্চবিদ্যালয়, ১ হাজার ৯০০ মাদ্রাসা, ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬ হাজার ৮০০ পুলিশ স্টেশন, ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৭ হাজার ৪০০ কিলোমিটার স্থানীয় সড়ক, ২০ হাজার ব্রিজ, ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে যে ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুতির অভাব রয়েছে তা-ও স্বীকার করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, পার্বত্য সীমান্ত আর সিলেট অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। যেখানে ভূমিকম্প হলে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহসহ জনবহুল শহরগুলোতে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বাংলাদেশ ৮ দশমিক ৩ থেকে ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলেন, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি রোধে গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করতে হবে। ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ঝুঁকি প্রশমনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ভবন তাত্ক্ষণিকভাবে ধসে পড়বে। এতে ব্যাপক প্রাণহানি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলে রয়েছে। অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশ ও আশপাশে হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এটা কিন্তু হবে। বাংলাদেশের আশপাশে ভূমিকম্পের ইপি সেন্টার বা কেন্দ্র আছে। এ কারণে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। তবে এটা কবে হবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৭ মাত্রার মতো বড় ভূমিকম্প হয়েছে মানিকগঞ্জে ১৮৮৫ সালে। এটার নাম ছিল বেঙ্গল আর্থকোয়াক। আরেকটা হয়েছে শ্রীমঙ্গলে ১৯১৮ সালে, এটার নাম শ্রীমঙ্গল আর্থকোয়াক। শ্রীমঙ্গল আর্থকোয়াকের উৎপত্তিস্থলের আশপাশে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে টাঙ্গাইল, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তবে ঐ ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।