ধীরে নামছে সুরমার পানি * মানুষ বাঁচাতে লঙ্গরখানা খোলার দাবি
ভয়াবহ বন্যায় তুমুল বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে সিলেট-সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা। ঘরবাড়ি হারানো লাখ লাখ মানুষ স্বপ্ন দেখার জোরটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। বন্যার পানিতে প্লাবিত একের পর এক এলাকা দেখে মনে হচ্ছে, যেন রাতারাতি কোনো বড় নদীর আবির্ভাব ঘটেছে। বন্যার তাণ্ডবে সিলেট-সুনামগঞ্জের অধিকাংশ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধানের জমিগুলো এখন কাদা আর জঞ্জালে ভরা। গ্রামের পর গ্রামে কোনো স্কুল, হাসপাতাল, মন্দির বা মসজিদ চোখে পড়ে না। কেবল পানি আর পানি। মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে ছোট নৌকা কিংবা কলাগাছ ও বাঁশ দিয়ে বানানো ভেলায় করে। ত্রাণ পরিবহনরত কারোর দেখা পেলেই তাদের চোখগুলোতে আলোর ঝিলিক দেখা দেয়। গতকাল বুধবার সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গত এলাকার চিত্র এমন।
বন্যার আট দিন পর সুরমা নদীর পানি ধীরে ধীরে কমায় সিলেটের কিছু অংশে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়তে থাকায় নতুন করে সিলেটের বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে বাড়ছে দুর্ভোগ। পাশাপাশি বন্যাক্রান্ত এলাকায় তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। সরকার পর্যাপ্ত ত্রাণের কথা বললেও বন্যাক্রান্ত মানুষ বলছেন, তারা না খেয়ে আছেন। অন্যদিকে সুধীজনরা বলছেন, খাদ্যসংকট থেকে মানুষকে বাঁচাতে সরকারকে অন্তত আগামী দুই মাসের জন্য ‘লঙ্গরখানা’ খুলতে হবে।
বন্যাদুর্গত এলাকার সবখানে পানি। অথচ খাবার নাই এক ফোঁটাও। বাড়ির বাইরের দৃশ্য আর নিজেদের করুণ পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল বুধবার সিলেটের গোয়াইনঘাটের বাঘের সড়ক বাজারের পাশে খাগড়া গ্রামের প্রমীলা রাণী সরকার বলেন, ‘আক্তা (হঠাৎ) পানি বাড়ি গেলে আমরা দৌড় দিয়া ঘর থাকি বাইরই যাই। ঘরের যা আছলো সব পানিয়ে লইয়া গেছেগি।’ পরনের শাড়ি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই কাপড়ও পাশের ঘরের দিপ্তি রাণী দিছে।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘হুরু পোয়ারে বিয়া করানির লাগি ঘরে কিছু টেকা রাখছিলাম’, ‘সুন্দর বউ আনার স্বপ্নও আছিল। কিন্তু বানের পানি সব ভাসাইয়া নিছে, সঙ্গে স্বপ্নও। আরেকটু দূরে শুভাসী রাণী সরকারের ঘরের কাদামাখা
বারান্দায় দেখা গেল, কচু কেটে রাখা হয়েছে। ঘরের ভেতরে, আসবাবপত্র বলতে কিছুই নেই। কয়েকটি টিন মাটির ওপর ফেলে তার ওপর দিয়ে হাঁটাচলা করছেন তারা। চারদিন পরে আজ (বুধবার) তারা ভাত খাবেন জানিয়ে শুভাসী বলেন, ‘টেকা নাই, ধান নাই, ঘর নাই। সব ভাসাইয়া লইয়া গেছেগি।’ সকালে দোকান থাকিয়া দুই কেজি চাল বাকিতে আনিছি। কচু দিয়া শুঁটকি রান্ধিয়া খাইমু।’ এমন দুর্যোগেও তাদের কেউ ত্রাণ দেননি বলে জানান। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অঙ্গসংগঠন মহিলা ঐক্য পরিষদের সিলেট জেলা শাখা ওই গ্রামে প্রথমবারের মতো ত্রাণ নিয়ে যায়। ওই দলের সহযাত্রী হয়ে এই প্রতিবেদক সেখানে গেলে গোয়াইনঘাটের খাগড়া গ্রামের বিপর্যয়ের চিত্র বেরিয়ে আসে।
গোয়াইঘাটের খাগড়া গ্রাম পেরিয়ে একটু সামনে দেখা মেলে রেনু বিশ্বাসের। তিনি বলেন, পানির কারণে আটকা পড়ে আছি। কিন্তু খাওয়ার পানি নেই। খাবার নেই। তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত। কী করব, কোথায় যাব? প্রত্যেকটা জিনিস অনেক কষ্ট করে কিনেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, বানের পানি বিছানা, চেয়ার সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন কিছুই নেই।
আক্রান্তরা জানান, সুরমার পানিতে লণ্ডভণ্ড সিলেট জেলার উত্তরপূর্বের উপজেলা গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানিগঞ্জ ও জৈন্তাপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনো পানির নিচে। যোগাযোগও পুনঃস্থাপিত হয়নি। ভারত থেকে কানাইঘাটের রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের ওপর দিয়ে লোভা নদী বাংলাদেশে ঢুকে সুরমায় মিলিত হয়েছে। দুই নদীর পানির তীব্ররোষে পুরো এলাকা প্লাবিত। পর্যটনকেন্দ্র লোভাছড়ার বাজার, গ্রাম- সবই এখন পানির নিচে। গোয়াইনঘাটের ডাউকি সীমান্ত দিয়ে পিয়াইন নদী গোয়াইনঘাট এবং কোম্পানিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবিয়ে সিলেট সদর উপজেলার একটি বড় অংশকে সঙ্গে নিয়ে ছাতকে গিয়ে সুরমার সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই জনপদকে ভাসিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি জৈন্তাপুরের লালাখাল সীমান্ত দিয়ে সারী নদী বাংলাদেশে ঢুকে সালুটিকর ডুবিয়ে ছাতকে গিয়ে পিয়াইন এবং সুরমার সঙ্গে মিলিত হয়ে পুরো এলাকা ডুবিয়েছে। ৮ দিন ধরে এসব এলাকা পানির নিচে। দুর্যোগ এতই ভয়ঙ্কর হয়েছে, বহু জায়গায় মানুষ না খেয়ে আছেন।
জানতে চাইলে সিলেটের কানাইঘাট সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক বীনা রাণী সরকার ভোরের কাগজকে বলেন, পুরো এলাকা এখনো জলমগ্ন। বহু এলাকায় মানুষ ত্রাণ নিয়ে যেতে পারছেন না। বন্যার পানি কমার পর মানুষের কষ্ট আর আহাজারিতে পুরো এলাকায় অন্য রকম কষ্ট ছুঁয়ে যাবে।
সিলেট জজকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী প্রদীপ ভট্টাচার্য্য ভোরের কাগজকে বলেন, আগামী ৫০ বছরের ভেতরে বাংলাদেশের বিরাট একটি অংশ জলের তলায় চলে যাবে। সিলেট-সুনামগঞ্জের চলমান বন্যা দেখে মনে হয়েছে, ৫০ বছর খুব কাছে এসে গেছে। এই দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য খাদ্য, ওষুধ, বিশুদ্ধ পানি নিয়ে আক্রান্তদের পাশে যেতে হবে। আগামী মাস দুয়েক বিপদগ্রস্ত মানুষের বিনামূল্যে খাওয়াতে হবে। নতুবা জনপদজুড়ে মানুষের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যাবে।
বেপরোয়া কুশিয়ারা : ধীরে ধীরে কমছে সুরমার পানি। তবে এখনো বিপদসীমার উপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে বাড়ছে কুশিয়ারার পানি। এতে নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জের নতুন নতুন এলাকা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল ভোর থেকে কুশিয়ারা নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক বেয়ে সুরমা নদীতে উপচে পড়ছে। বর্তমানে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কে চারখাই থেকে উপজেলার তেরমাইল পর্যন্ত হাঁটু পানি রয়েছে। পানির কারণে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। গোলাপগঞ্জ উপজেলার ১৮০টি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৮টিতে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। ১৮টিতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধিতে প্লাবিত হয়ে পড়ায় লোকজনকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হচ্ছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রায় শতাধিক ঘরে নতুন করে পানি ঢুকে পড়ায় লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বুধবারী বাজার ইউনিয়নের বহর গ্রাম এলাকার বাসিন্দা আবু সাইদ জানান, কোমর পর্যন্ত পানি উঠে পড়ায় ভাদেশ্বর মীরগঞ্জ বাজারের সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কুশিয়ারার প্রবল স্রোতে জকিগঞ্জের আমলসীদে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে। এতে উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়ে
তলিয়ে গেছে রাস্তা ঘাট, আউশ ক্ষেত, বীজতলা ও মাছের খামার। পানি উঠে যাওয়ায় সড়কে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ফলে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন ওইসব এলাকার মানুষ।
বিয়ানীবাজার উপজেলার কুড়ারবাজার, মুড়িয়া, লাউতা, শেওলা, মাথিউরা, মোল্লাপুর ইউনিয়ন ও পৌরসভাসহ উপজেলার প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। উপজেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, গতকাল দুপুর পর্যন্ত বিয়ানীবাজারের ২৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৩ হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন।
বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে বালাগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৬০ ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধির ফলে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বন্যা আক্রান্ত এলাকায় পানি বেড়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জের ইলাশপুর এলাকায় সিলেট-মৌলভীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার অন্তত ৬০ ভাগ মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি রয়েছেন।
দিরাইয়ে হাহাকার : এদিকে সুনামগঞ্জের দিরাই থেকে আমাদের প্রতিনিধি জয়ন্ত কুমার সরকার জানিয়েছেন, বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বসত ঘরের বেড়া, পানি ঢুকেছে কৃষকের একমাত্র সম্বল ধানের গোলা। হাওরের উত্তাল ঢেউ ভাসিয়ে নিয়েছে গোলার ধান। গবাদিপশুর লাশ ভেসে উঠছে যত্রতত্র। কোথাও কোথাও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় বিপাকে পরা কৃষক পরিবারগুলো অপেক্ষাকৃত উঁচু বাড়িগুলোতে আশ্রয় নিলেও খেয়ে না খেয়ে কোনোরকম বেঁচে আছেন। সেখানে ত্রাণ সুবিধা এমনকি, শুকনো খাবার পর্যন্ত পৌঁছেনি। দুর্গম এলাকা ও বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিজেলচালিত নৌকাগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে।
পানিতে তলিয়ে গেছে বিশুদ্ধ পানির একমাত্র ভরসা গভীর নলকূপগুলো। স্থানীয় বাজারগুলোতে পানি উঠে যাওয়ার ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ লোকজন কেনাকাটা করতে পারছেন না। সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা
বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজানগর, রফিনগর, জগদল ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় রাতে চোর-ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে।
দিরাই উপজেলার সরকারি-বেসরকারি অন্তত ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে মিলছে না কোনো খাদ্য সহযোগিতা। নিজ ঘরে কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে রফিনগর ইউনিয়নের সজনপুর গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মতিউর রহমান জানান, তার অন্তত দুইশ মণ ধান ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ৩টি বাছুর (গরুর বাচ্চা) খুঁজে পাচ্ছেন না। কোথাও হয়তো মরে ভেসে উঠেছে। এদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় দিরাই বাজারে জেনারেটর দিয়ে মোবাইলের চার্জ করা নিয়ে দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। বাধ্য হয়ে কোথাও কোথাও ১০০ টাকায় বিনিময়ে মোবাইলে চার্জ করিয়ে নিচ্ছেন তারা।
আজ থেকে চালু হচ্ছে ওসমানী বিমানবন্দর : বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে। দুদিন পর বন্যার পানি নেমে গেলেও এপ্রোচ লাইট তলিয়ে থাকার কারণে গত ৫ দিন বন্ধ ছিল সিলেট বিমানবন্দরে ফ্লাইট উঠানামা। তবে শেষ পর্যন্ত আজ বৃহস্পতিবার থেকে ফের চালু হচ্ছে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বাংলাদেশ বেসামরিক চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিচালন ও পরিকল্পনা) এয়ার কমোডর সাদিকুর রহমান চৌধুরী গতকাল ভোরের কাগজকে জানান, আজ বৃহস্পতিবার থেকে ওসমানী বিমানবন্দরে ফ্লাইট চালু হবে।