‘বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে রোলমডেল, বিশেষ করে বন্যা তদারকি’-এই একটি বাক্য জীবনে কতবার পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই! কিন্তু বই থেকে জানা আর বাস্তবের দেখায় ব্যবধান আকাশপাতাল।
মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্রের তৎপর থাকাটাই স্বাভাবিক। বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এমন প্রাকৃতিক সমস্যা মোকাবেলায় রাষ্ট্রের পূর্বপ্রস্তুতি থাকার কথা। সিলেট অঞ্চল দেশের মধ্যে অন্যতম বিভাগ। অথচ বন্যায় আটকে পড়া মানুষজন তেমন কোনো সরকারি সাহায্য পাচ্ছে না। প্রশাসন পর্যায়ে দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা নেই, বন্যাসংক্রান্ত বিষয়ে মিডিয়া কাভারেজ নেই। যেন সুনামগঞ্জ, সিলেট বাংলাদেশের অংশই নয়!
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার আকুতি ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। তিনি মানুষকে উদ্ধারের জন্য, পানিবন্দী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নৌকা চান; পাচ্ছেন না। তিনি লিখেছেন, ‘কোথাও ট্রলারমালিকদের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে উজান এলাকা থেকে একটা ট্রলারনৌকা কেউ ম্যানেজ করতে পারলে অতিসত্বর যোগাযোগ করুন।’ কতটা নিরুপায় পরিস্থিতিতে পড়লে এ রকম খোলা বার্তা একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিতে পারেন।
সিলেটে গত শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা চলছে। ষাট থেকে সত্তরোর্ধ্ব অনেকে বলছেন, তারা বন্যার এত পানি এর আগে কখনো দেখেননি। কী কারণে এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হলো তার সঠিক কোনো উত্তর সম্ভবত সরকারেরও জানা নেই। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সিলেটের প্রতিটি নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়েছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। মূলত, ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য মোটাদাগে এসব কারণই প্রধানত দায়ী। বিশেষ করে ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্য সঙ্কট তৈরি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ গবেষকদের অভিমত, ভবিষ্যতে বন্যা থেকে রেহাই পেতে সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদ-নদী খনন করা জরুরি। এ ছাড়া সিলেট নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো (প্রাকৃতিক) দখলমুক্ত করে খনন করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ নিশ্চিত করা দরকার।
ভূতাত্ত্বিকভাবে সিলেট একটি বৈচিত্র্যময় এলাকা। পাহাড়-টিলায় জনপদটি যেমন সমৃদ্ধ; তেমনি এখানে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ের কোনো কমতি নেই। তবে নদীগুলোর সব ক’টিরই উৎপত্তি হয়েছে ভারতে। সুরমা নদী ছাড়া বাকি নদীগুলোর বেশির ভাগ এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল জায়গা ভারতের মেঘালয় থেকে। তাই মেঘালয়ে বৃষ্টিপাতের কারণে যে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়, এর বেশির ভাগ চলে আসে সিলেটে।
সরকারের কোনোরকম পরিকল্পিত কার্যক্রম না থাকায় দীর্ঘ দিন ধরে পাহাড়ি বালু-মাটি-পলি জমতে জমতে নদ-নদীগুলো প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। অন্য দিকে অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের কারণে নদীগুলো ক্রমে সঙ্কুচিত ও ভরাট হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে নদীশাসনের নামে নদী-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড। যত্রতত্র স্লুইসগেট ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও নদীর প্রবাহপথ আরো বেশি সঙ্কুচিত হয়েছে। এতে এবার অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানি জমে বন্যার সৃষ্টি করেছে।
গত মে মাসের শেষ দিকে একবার বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল সিলেট। এ নিয়ে সিলেট অঞ্চলে এ বছর তিন দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় শুরু হওয়া বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরো কয়েকটি কারণ দেখছেন গবেষকরা। সব মিলিয়ে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন বলে কর্তৃপক্ষ বলছে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়েও কেন বন্যা ঠেকানো যাচ্ছে না এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই রাষ্ট্রের। সুনামগঞ্জের সাথে দেশের বাকি অংশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নেত্রকোনার সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রেল যোগাযোগ। এর পাশাপাশি রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ দেশের আরো কয়েকটি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয়বাষ্প মেঘালয়ের পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে উপরে উঠে যায়। সেখানে ভারী হয়ে বৃষ্টি আকারে পড়তে শুরু করে।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অতিবৃষ্টির কারণে এবারের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এবার তিন দিনে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হয়েছে দুই হাজার ৪৮৭ মিলিমিটার এবং এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এ রকম ধারাবাহিক বৃষ্টি হয়েছে ১৯৯৫ সালে একবার, তিন দিনে দুই হাজার ৭৯৮ মিলিমিটার আর ১৯৭৪ সালে দুই হাজার ৭৬০ মিলিমিটার।
চেরাপুঞ্জি এলাকাটি সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্তসংলগ্ন। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে এসে মেশে। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলে সে পানি ছয় থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে তাহিরপুরে চলে আসে। কিন্তু সেখানে এসে পানি আর দ্রুত নামতে পারে না। ফলে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যার সৃষ্টি করে। কিন্তু অতীতের বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষাপট আর এখনকার নদীগুলোর অবস্থার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে বলে নদী গবেষকরা মনে করছেন। গবেষণায় স্পষ্ট, এই হঠাৎ বন্যার পেছনে চেরাপুঞ্জীর প্রবল বৃষ্টিপাতই দায়ী। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া-জলবায়ু বা বৃষ্টির ধরন বদলে গেছে। এখন বৃষ্টি হলে অনেক বেশি গভীর বৃষ্টি হয়। প্যাসিফিকেও একটি লা নিনা আছে। এটিও অতিবৃষ্টির পেছনে ভ‚মিকা রেখেছে।
অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের আসামেও বন্যা এবং ভ‚মিধসের সৃষ্টি হয়েছে। আসামে বরাক ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গৌহাটিসহ অনেক এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। আসাম, মেঘালয় মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিচ্ছে, আসামের বন্যায় অন্তত ১১ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নদীর পানি বহনের ক্ষমতা অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদীপথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। কিন্তু এবারের বন্যার পেছনে হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বের হতে না পারাটাও অন্যতম কারণ। প্রতি বছর উজান থেকে পানির সাথে পলি আর পাথর নেমে আসে। পলি এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি এলে তা বন্যার সৃষ্টি করে।
বন্যার পেছনে মানুষের নিজেদের তৈরি কতগুলো কারণ তো অবশ্যই রয়েছে। হাওরে বিভিন্ন জায়গায় আমরা রোড করে ফেলেছি। ফলে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে ও অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে।
এটি সত্য যে, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা তৈরির কারণে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া বন্যার অন্যতম কারণ। হাওরে যেসব রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমে তৈরি করা হয়েছে সেগুলোই হাওরের পানি চলাচলে মূল বাধা সৃষ্টি করছে। এ রকম অনেক রাস্তা কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে। হাওরে সড়ক বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অপরিকল্পিতভাবে চলছে। সে কারণেই বন্যা এ রকম তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।
তাছাড়া সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনা হাওর এলাকায় বেশির ভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোনো কারণে হাওরে বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তা খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। হাওরের সেসব এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়নি। তা করা না হলে বাড়িঘর উঁচু করে তৈরি করতে হবে, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। সেটিও করা হয়নি। ফলে আকস্মিক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হচ্ছে। চীনসহ অনেক দেশে স্পঞ্জ সিটি তৈরি করা হচ্ছে। এসব শহরে বন্যা হলে সেই পানি শহরের ভেতরেই জমিয়ে রেখে কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এবার বাংলাদেশে যেভাবে আকস্মিকভাবে বৃষ্টির বা পানি বৃদ্ধির রেকর্ড ভেঙে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে, এ রকম পরিস্থিতিতে বন্যা ঠেকানো খুব কঠিন বলে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ বলছেন।একটি সরকার নির্বাচিত কিংবা অবৈধ যেভাবেই হোক রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বে থাকলে, তারই নৈতিক দায়িত্ব যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দ্রæত সিদ্ধান্ত নেয়া। অথচ পুরো সিলেট অঞ্চল যখন পানিতে তলিয়ে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে, তখন কিছু সামাজিক সংগঠন ও বেশ কিছু আলেম ছাড়া কাউকেই দেখা যায়নি অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে। বিশ্ব মিডিয়ায় যখন মৃত্যুর খবর বের হয়, আমাদের মিডিয়া আনন্দ উৎসবের খবর নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অবশেষে সিলেটবাসীর দুঃখ লাঘবে সরকার সেনাবাহিনী নিয়োজিত করে। সরকার যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ দিয়েছে তা দুর্গত মানুষের প্রতি উপহাস বলেছেন অনেকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশিষ্ট আলেমদের নেতৃত্বে তাদের বিভিন্ন সংগঠন দুর্গত সিলেটবাসীর কাছে হাজির হয়েছে, ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। দেশের ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। তাদের এই আন্তরিকতা ও নিঃস্বার্থ ত্যাগ জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।