এবারের বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশে ১০ জেলার কোটি কোটি মানুষ জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বন্যায় ডুবে আছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ রাস্তাঘাট। ডুবে আছে ফসলের মাঠ, রাস্তাঘাট, বাসস্থান, পুকুরের মাছ। গোয়ালের গরু, বসবাসের শেষ আশ্রয়স্থলটুকুও এখন পানির নিচে। পানির কারণে ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা যাচ্ছে না। তবে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে স্থানীয় প্রশাসন আশঙ্কা করছে। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলসহ অন্যান্য জেলায় বড় ক্ষত তৈরি করেছে এবারের বন্যা। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্যায় কৃষক ও মৎস্যজীবীদের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাদের পুনর্বাসন কিংবা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকও মনে করছেন এবারের ভয়াবহ বন্যায় আউশ ধানের ক্ষতি একটু বেশি হতে পারে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ২২ হাজার হেক্টর ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া ৩ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে থাকা শাকসবজির ক্ষতি হয়েছে। এ জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রয়েছে। বড় ক্ষতি হলে পুষিয়ে নিতে সর্বোচ্চ সহায়তা দেবে কৃষি মন্ত্রণালয়।
নিঃস্ব কৃষক :সিলেটের হাওরাঞ্চলে এবার এমনিতেই এপ্রিলের প্রথম দিকে পাহাড়ি ঢলে ফসলহানি ঘটে। মে মাসে আবার ভারি বৃষ্টি ও উজানের ঢলে বিপদে পড়েন কৃষকরা। ওই সময় আধাপাকা কিছু ধান ঘরে তুলতে পেরেছিলেন চাষি। তবে এবারের বন্যা কেড়ে নিয়েছে সবকিছু, আঁকড়ে ধরার শেষ সম্বলটুকুও।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২০ সালের বন্যায় ৪৫০ কোটি টাকার মাছ ও পোনা ভেসে যায়। আর এই ক্ষতির অর্ধেকের বেশি এককভাবে হয়েছে সিলেট বিভাগের খামারি ও চাষিদের।
চলমান বন্যায় কৃষিতে ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব এখনও দিতে পারেনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ.মাহবুবুল হক গতকাল রাতে সমকালকে জানান, বন্যায় ১৫ জেলায় ৬৭ হাজার ৬১০টি মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে, যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৮২ টন। মাছ ও মাছের পোনা মিলে ক্ষতি হয়েছে ১৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
অন্য খাতেও ক্ষতি :বন্যাকবলিত এলাকার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে চেয়ার, বেঞ্চসহ আসবাব ও শিক্ষা উপকরণের ক্ষতি হয়েছে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহূত হচ্ছে।
সিলেট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, বন্যার পানিতে প্রায় ৩০ হাজার নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া জেলার প্রায় এক লাখ শৌচাগার তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পানি সরবরাহের পাইপলাইনও।
বাড়বে দারিদ্র্য :বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যার পানি কমলেও স্বস্তির ঢেঁকুর তোলার কারণ নেই। বানভাসিদের অন্তহীন দুর্গতির মধ্যেই থাকতে হবে। পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, যখন পানি থাকে, তখন অনেক সহৃদয় মানুষ দুর্গত মানুষের পাশে থাকেন। সরকারও কিছুটা পাশে থাকে। পানি নেমে গেলে বানভাসিরা হয়ে পড়েন একা। পানি কমে গেলে গণমাধ্যমে দুর্গতদের নিয়ে আর তেমন কোনো সংবাদ প্রকাশ হয় না। বানভাসিরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেটুকু গুছিয়ে নেন, তা আবার পরের বছরের বন্যায় নিঃশেষ হয়। সিলেট ও সুনামগঞ্জে পানি কমতে শুরু করলেও ডুবে থাকা ঘরবাড়ির যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতি পূরণ করার মতো সক্ষমতা অনেকের নেই।
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের (খানি) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ বলেন, ফসলের যা সর্বনাশ হওয়ার হয়েছে, পানি কমে গেলে তো আর ফসল ফিরে আসবে না। যার পুকুর ডুবে গেছে, তিনি তো আর মাছ ফিরে পাবেন না। তাঁদের যাওয়ার বড় জায়গা স্থানীয় মহাজন। তাঁরা জানেন, এসব মহাজন তাঁদের কাছে অনেক টাকা সুদ নেবেন। তার পরও আর কোনো উপায় থাকে না। তাদের।
এমন ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে বহু বছর। ফলে সরকারকে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। যাতে দুর্গত মানুষ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, বিভিন্ন খাত ও ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মিলিয়ে নগর ও জেলায় অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও মৎস্যজীবীরা যেন আবার নিজেদের পেশায় ফিরতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনে তাঁদের পুনর্বাসন কিংবা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়াসহ নানামুখী সহায়তা দেওয়া হবে।