দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন। সম্পূর্ণ নতুন এক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হয় ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত এবারের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলনের আগে থেকেই ব্রিকস নিয়ে সারা বিশ্বে একধরনের আলোচনা, আগ্রহ তৈরি হয়, যা ব্রিকস সম্মেলনে যোগ করে নতুন মাত্রা। এতটা বড় পরিসরে এ ধরনের আগ্রহ দেখা যায়নি অতীতে।
আমরা জানি, ব্রিকস বরাবরই কোনো সামরিক জোট বা কোনো আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফরম নয়। এখানে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তবে এবারের শীর্ষ সম্মেলনে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে আলোচ্য ছিল। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্রিকসের সম্প্রসারণ ঘটবে কি না। এক্ষেত্রে ব্রিকস এবার গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন কিছু রাষ্ট্র ব্রিকসে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ব্রিকসের সদস্য হবে এই দেশগুলো, যার ফলে ব্রিকস লাভ করবে একটি সম্প্রসারিত কাঠামো। এই যে সম্প্রসারণ, এটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন রকম বক্তব্য ছিল এবং লক্ষ করা যায়, ৪০টি রাষ্ট্র ব্রিকসের সঙ্গে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই পর্যায়ে ছয়টি রাষ্ট্রকে ব্রিকসে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবারের শীর্ষ সম্মেলনে। এই সুযোগদানের ক্ষেত্রে ব্রিকসের প্রতিষ্ঠাকালীন রাষ্ট্রসমূহের ভেতরে মতের ভিন্নতা ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, সর্বসম্মতিক্রমে ব্রিকসের এই সম্প্রসারণ ঘটেছে।
ব্রিকস সম্প্রসারণের ব্যাপারে যে মতের ভিন্নতা থাকবে, তা অস্বাভাবিক নয়। তবে আরো কিছু রাষ্ট্রকে যুক্ত করা সম্ভব হতো, যদি সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ভেতরে মতের ভিন্নতা না থাকত। এখানে আমরা লক্ষ করেছি, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ কিংবা ভিয়েতনাম বা বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ এই পর্যায়ে যুক্ত হতে পারেনি। ব্রিকসের এই যে সম্প্রসারণ বা ব্রিকসের প্রতি যে আগ্রহ, এর যেমন অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি ব্রিকসের সম্মেলনের আগে থেকেই আলোচনায় এসেছিল, তা হালো ডিডলারাইজেশন বা আন্তর্জাতিক মুদ্রার ওপরে নির্ভরশীলতা হ্রাস করার জন্য ব্রিকস কোনো মুদ্রা চালু করবে কি না। যদিও ব্রিকসের নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তেমন কোনো ইতিবাচক বক্তব্য রাখেননি। তবে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি যে ধরনের সংকট ও কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ডলারের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার যে বড় তারতম্য তৈরি হচ্ছে এবং তার প্রেক্ষাপটে যে উত্কণ্ঠা তৈরি হয়েছে, তা লাঘব করার জন্য একটি অভিন্ন ব্রিকস মুদ্রা চালু করা কিংবা কোনো ধরনের বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা তৈরির বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে এরকম আশা করা হয়েছিল। যদিও ব্রিকস এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, কিন্তু তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হালো, ব্রিকস সদস্যসমূহের ভেতরে নিজস্ব মুদ্রায় বা স্থানীয় মুদ্রায় আরো বেশি বাণিজ্য করার প্রতি উত্সাহিত করা। ভবিষ্যতে হয়তো একটি অভিন্ন মুদ্রার জন্য ব্রিকস আরো বেশি কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।
ব্রিকস সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, ব্রিকসের মাধ্যমে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) নামে যে ব্যাংক স্থাপন করা হয়, তার কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করা। এটিকে আরো শক্তিশালী করার প্রস্তাব এসেছে। এটির পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ এনডিবির সদস্য। এই সংস্থার অন্য সদস্যদের নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে।
এবারের ব্রিকস সম্মেলনে একটি যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেমন—বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করে একটি বৈশ্বিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য একটি বড় ধরনের তাগিদ অনুভূত হয়েছে। এই যৌথ ঘোষণায় একদিকে ব্রিকস দেশগুলোর ভেতরে অংশীদারিত্বের কথা বলা হয়েছে; অন্যদিকে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে জ্বালানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে আরো সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং টেকসই উন্নয়নের বিষয়ে দেশগুলোকে আরো বেশি সংযুক্ত করার মতো বিষয় উঠে এসেছে। অর্থাত্, বলা যায়, একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার রোডম্যাপ তথা নতুন একটি বিশ্ব পরিস্থিতির ব্লুপ্রিন্ট এবারের সম্মেলনে দেখতে পেয়েছি আমরা। এখানে বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেগুলো সমাধানের ব্যাপারেও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ, টেকসই উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ের ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ব্রিকস আরো বেশি নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিশ্বের তরুণ সমাজের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
এবারের ব্রিকস সম্মেলনকে আমরা যদি আন্তর্জাতিক রাজনীতির জায়গা থেকে বিবেচনা করি, তবে দেখা যাবে, একটি পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সম্মেলন আয়োজন করার মাধ্যমে ব্রিকস সন্দেহাতীতভাবে একটি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। আমরা জানি, ব্রিকসের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজটি বেশ জটিল। এই অবস্থায় সম্প্রসারণের মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ব্রিকসের প্রভাব আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে। ব্রিকসের যে অর্থনীতি, সে অর্থনীতিকে যদি জোট হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তবে আঞ্চলিক জোটের মধ্যে ব্রিকসই সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে বলতে হবে। বিশ্বের প্রায় ৪২ শতাংশ জনসংখ্যার অন্তর্ভুক্তিতে ব্রিকসের বর্তমান জিডিপি ৩১ শতাংশ। নতুন অংশ নেওয়া দেশগুলোকে যোগ করলে, তা ৩৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। তাই ব্রিকস বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করছি। পাশাপাশি সদস্য রাষ্ট্রসমূহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যুক্ত হয়েছে, যা ব্রিকসের আরেকটি সাফল্য। এর মধ্য দিয়ে ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য আরো বেশি মজবুত হবে আগামীর দিনগুলোতে। কারণ, আমরা দেখতে পাচ্ছি, অতীতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে খুব একটা অংশগ্রহণ ছিল না ব্রিকসে; কিন্তু এখন মধ্যপ্রাচ্যের দুটি রাষ্ট্র অংশগ্রহণ করেছে। ব্রিকসে আরেকটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, সেটি হচ্ছে বিশ্বের তেল উত্পাদনকারী রাষ্ট্রগুলো যুক্ত হয়েছে। ইরানের মতো রাষ্ট্র যুক্ত হয়েছে, যুক্ত হয়েছে সৌদি আরব। ইরান ও সৌদি আরবের অংশগ্রহণ থেকে বোঝা যায়, রাষ্ট্র দুটি তাদের নিজেদের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে স্থাপন করেছে। এখানে ব্রিকস সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। ইরান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক ভিন্নতা আমরা লক্ষ করি। অথচ সেই দুটি রাষ্ট্র যোগদানের ক্ষেত্রে ঐকমত্য পোষণ করেছে। অর্থাত্, ব্রিকসের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করার ক্ষেত্রে ইরান ও সৌদি আরব একই রকম চিন্তা করছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কোন রাষ্ট্র কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে, সেটি অবশ্য প্রশ্ন সাপেক্ষ। কিন্তু ব্রিকসের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে বিশেষ করে এই রাষ্ট্র দুটি একই চিন্তা করেছে। ফলে এটিও ব্রিকসে একটি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে নিঃসন্দেহে।
ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ বৈঠক থেকে আমরা যে বার্তাটি পাচ্ছি, সেটি হচ্ছে বিশ্ব কূটনীতি, বিশ্ব রাজনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্রিকস তার যে আগের অবস্থানে ছিল, সেই অবস্থান আরো সুসমন্বিত করেছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে আগামী দিনে ব্রিকসের প্রভাব আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবং এই মুহূর্তে আমরা যে বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি, সেটি আরো সামনে চলে আসছে এবং বিশ্বে ব্রিকসের এই বহুমেরুকেন্দ্রিকতার আরো বেশি বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে।
আমরা জানি, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন এবং সেখানে একটি বক্তব্য প্রদান করেছেন। ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশের এই অংশগ্রহণ—এটিও ব্রিকসের একটি কূটনৈতিক সাফল্য। কারণ, ব্রিকসে আফ্রিকার বাইরে খুব বেশি রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আফ্রিকার বাইরে যে কয়েকটি রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ব্রিকস সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে যে ধরনের কূটনৈতিক সাফল্য দেখিয়েছেন, তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। মনে রাখতে হবে, নিষেধাজ্ঞা ও পালটা নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে একধরনের সংকট বিরাজ করছে। এই সংকটময় সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করছে। ব্রিকস সম্মেলনে এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকি বিশ্বের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের যে ভাবনা, সেটিও তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, যা বাংলাদেশের কূটনীতির জন্য সাফল্য বয়ে এনেছে।
ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কথাগুলো বিবেচনা করলেও লক্ষ করা যায়, ব্রিকসের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির বিষয়ে অনেকে আলোচনা করছেন। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির মূল সুর ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্রিকসের মাধ্যমে আসলে একটি ‘নতুন দর-কষাকষির জায়গা’ তৈরি হয়েছে দক্ষিণের দেশগুলোর (গ্লোবাল সাউথ) জন্য। এর মাধ্যমে দক্ষিণের দেশগুলো একত্রে অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানেও রাখতে পারে ইতিবাচক ভূমিকা। এভাবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্ব যেহেতু বহুমেরুকেন্দ্রিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে জোটভুক্ত বা গ্রুপভিত্তিক দেশগুলোর সম্ভাবনাই বেশি। এটির ইতিবাচক ফলাফল লক্ষ করা যাবে আগামী দিনগুলোতে।