বিধান চন্দ্র দাস
পৃথিবীতে বায়ুদূষণ দিন দিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। বিশ্ব পরিবেশ কর্মসূচি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিখ্যাত সব বিজ্ঞান সাময়িকী (সায়েন্স, নেচার, ল্যানসেট) ক্রমাগতভাবে এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন, গবেষণা প্রবন্ধ, মতামত ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে চলেছে। এসব সংস্থা ও বিখ্যাত জার্নালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। তবে এই পরিসংখ্যান মানুষের ওপর বায়ুদূষণের অভিঘাত সম্পর্কিত সার্বিক চিত্র বলা যাবে না। কারণ মৃত্যু ছাড়াও পৃথিবীতে অগণিত মানুষ বায়ুদূষণের কারণে কর্মক্ষমতা লোপ, শারীরিক কষ্ট তথা অসুস্থ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
আগে ধারণা করা হতো, বায়ুদূষণের ফলে শুধু শ্বাসতন্ত্রেই নানা ধরনের রোগ হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, শ্বাসতন্ত্র ছাড়াও বায়ুদূষণ মানবদেহে অনেক ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। ২০১৮ সালে ‘স্প্রিংগার’ থেকে বায়ুদূষণঘটিত রোগের ওপর একটি গ্রন্থ (ক্লিনিক্যাল হ্যান্ডবুক অব এয়ার পলিউশন রিলেটেড ডিজিজেস) প্রকাশিত হয়েছে। গবেষক, চিকিৎসক তথা বিজ্ঞানী মিলিয়ে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি লিখেছেন এই গ্রন্থে। স্ট্রোক, ১৪ ধরনের হৃদরোগ, ফুসফুস, স্তন, মূত্রথলির ক্যান্সার, সিওপিডি, হাঁপানি, ফুসফুস সংক্রমণ, চর্মরোগ, অ্যালার্জি, ৯ ধরনের চোখের অসুখ, সংক্ষিপ্ত গর্ভাবস্থা, বন্ধ্যাত্ব, অনিয়মিত ঋতুচক্র, শিশুর জন্মকালীন রুগ্ণতা ও বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, স্নায়ু বৈকল্য, ডিমেনশিয়া, আলঝেইমারস, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষতি, টাইপ-২ ডায়াবেটিসসহ বহু রোগের সঙ্গে বায়ুদূষণের সম্পর্ক রয়েছে বলে এই গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে।
বায়ুদূষণ শুধু মানুষের ক্ষতি করছে না। গবেষকরা বলছেন, বায়ুদূষণের ফলে গোটা জীবজগৎ (প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীব) এবং বাস্তুতন্ত্রেরও ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদূষণের অভিঘাত মানুষের চেয়ে অন্য প্রাণীদের (পরিফেরা থেকে কর্ডাটা) ওপর বেশি হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুদূষণ একে অন্যকে প্রভাবিত করে। ল্যানসেট গ্রুপের ‘প্ল্যানেটরি হেলথ’ (জানুয়ারি ২০২২)-এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষায় প্রমাণিত যে বায়ুদূষণ স্থাপনারও ক্ষতি করে। ভবন, ভাস্কর্য, বিশ্ব ঐতিহ্যের নানা স্থাপনাও বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী বায়ুদূষণ হচ্ছে ঘরের ভেতর কিংবা বাইরে এক বা একাধিক ভৌত, রাসায়নিক বা জৈব পদার্থের উপস্থিতিতে বায়ুর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন, যা মানুষ তথা জীবজগৎ, জলবায়ু কিংবা অন্য বস্তুর জন্য ক্ষতিকর। বায়ুর মধ্যে ভৌত, রাসায়নিক বা জৈব পদার্থের উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বায়ুদূষণকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো : ১. গ্যাসীয় দূষণ (ওজোন, নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি), ২. ভাসমান কঠিন কণাজনিত দূষণ (ধূলিকণা, কয়লা, ইট, সিমেন্ট, ছাই প্রভৃতির কণা, বিভিন্ন ধাতব পদার্থের কণা, পরাগ রেণু, জীবাণু ইত্যাদি), ৩. ভাসমান তরল কণাজনিতদূষণ (এসিড কণা, ধোঁয়াশা), ৪. তেজস্ক্রিয় পদার্থজনিত দূষণ (রেডিওঅ্যাকটিভ ডাস্ট)। শিল্পসভ্যতা শুরু হওয়ার পর থেকে বায়ুদূষণের জন্য মানবসৃষ্ট উৎসগুলোই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : যানবাহন (ডিজেল, পেট্রল, অকটেন প্রভৃতির দহন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট বিভিন্ন গ্যাস, চাকার ঘর্ষণজনিত সৃষ্ট বস্তুকণা), শিল্প-কলকারখানা (নানা পর্যায়ে সৃষ্ট বস্তুকণা, গ্যাস, ধোঁয়া ও মিস্ট), বিদ্যুৎকেন্দ্র (কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি, জৈব জ্বালানি থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন গ্যাস, জলীয় বাষ্প, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে রেডিওনিউক্লিয়াডস, নন-রেডিওঅ্যাকটিভ কেমিক্যালস), গৃহাভ্যন্তর (কাঠ, কয়লা, কেরোসিন থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া, গ্যাস ও বস্তুকণা, স্যাঁতসেঁতে ঘরে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ও ফানজাই, সিনথেটিক পেইন্টিং, ছাপার কালি, আঠা, রাসায়নিক ক্লিনিং, পারফিউম ও এয়ার ফ্রেশনার থেকে সৃষ্ট রাসায়নিক বাষ্প), কৃষি (কীটনাশক/বালাইনাশক, সার, রোমন্থনসৃষ্ট গ্যাস), নির্মাণকাজ (রাস্তা, ভবন নির্মাণকালীন নির্গত বস্তুকণা ও গ্যাস), খনি (খনিজদ্রব্য আহরণজনিত ধুলো ও রাসায়নিক), ভস্মীকরণ (ময়লা-আবর্জনা ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট আবর্জনা পোড়ানোর দ্বারা সৃষ্ট গ্যাস ও বস্তুকণা), পারমাণবিক চুল্লি/বোমা (বিস্ফোরণজনিত তেজস্ক্রিয় দূষণ)। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সৃষ্ট সালফার, কার্বন ও নাইট্রোজেনের অক্সাইডস বাতাসের জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে সালফিউরিক এসিড, কার্বনিক এসিড ও নাইট্রিক এসিড তৈরি করে। এরপর অম্লধর্মী (পিএইচ ৫.২-এর নিচে) এই তরল বৃষ্টি (এসিড বৃষ্টি), তুষার, কুয়াশা আকারে পৃথিবীতে নেমে আসে। প্রাকৃতিক কিছু কারণ, যেমন—বজ্রপাত ও আগ্নেয়গিরির কারণেও বাতাসে এসিডিক তরল তৈরি হতে পারে। বায়ুদূষণের প্রাকৃতিক উৎসর মধ্যে দাবানল (সৃষ্ট বস্তুকণা ও গ্যাস, মানুষের কারণেও দাবানল হতে পারে), আগ্নেয়গিরি (উদগীরিত গ্যাস ও বস্তুকণা), ধূলিঝড় (বস্তুকণা), পচনশীল জীবদেহ (ভাগাড়সহ অন্যান্য জায়গায় উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃতদেহ পচন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মিথেন গ্যাস), রেডিও অ্যাকটিভ রকস (ভূত্বকের ক্ষয় প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট রাডন গ্যাস) ইত্যাদি প্রধান।
সাধারণভাবে বায়ুদূষণ পরিমাপের জন্য গ্যাসীয় দূষণ ও ভাসমান কঠিন কণাজনিত দূষণ বিবেচনায় নেওয়া হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে বায়ুতে ভাসমান তরল কণা ও তেজস্ক্রিয় পদার্থসহ বিভিন্ন ধরনের রশ্মির উপস্থিতিও মাপা হয়। বাতাসে মিশে থাকা যেসব বস্তুকণার ব্যাস ২.৫ থেকে ১০ মাইক্রোমিটার বা মাইক্রন (এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগ), বায়ুদূষণ পরিমাপে তাদের বিবেচনায় নেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুদূষণ নির্দেশিকায় (২০২২) প্রতি ঘনফুট বাতাসে মিশে থাকা ২.৫ ও ১০ মাইক্রোমিটার ব্যাসবিশিষ্ট বস্তুকণা ও চার ধরনের গ্যাস (ওজোন, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড)-এর পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বস্তুকণা ও গ্যাস প্রতি ঘনফুট বাতাসে মিনিট/ঘণ্টা/বছর হিসাবে কী পরিমাণ উপস্থিত থাকলে তাকে দূষিত বাতাস বলা হবে, তার হিসাব দেওয়া হয়েছে।
বায়ুদূষণ দিন দিন ভয়ংকর হয়ে ওঠার কারণে জাতিসংঘ এর নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব জনসচেতনতা তৈরির জন্য ২০১৯ সালে সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস করে। সে অনুযায়ী ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ৭ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব ক্লিন এয়ার ফর ব্লু স্কাই’। প্রকৃতপক্ষে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য মানবসৃষ্ট উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আর এর জন্য আইন তৈরি, তার যথাযথ প্রয়োগ ও জনসচেতনতাও দরকার।
বাংলাদেশে বায়ুদূষণ দিন দিন প্রকট হতে চলেছে। গত ১৮ আগস্ট ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ঢাকা শহর বায়ুদূষণে পৃথিবীর শীর্ষ পাঁচ শহরের মধ্যে অবস্থান করছে বলে বলা হয়েছে। বোস্টনভিত্তিক বায়ুদূষণ সম্পর্কিত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘হেলথ ইফেক্ট ইনস্টিটিউট’ প্রকাশিত (২০২২) ফলাফলকে কেন্দ্র করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণায়ও দেশে বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে বলে উঠে এসেছে। ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’ (যুক্তরাষ্ট্র)-এর ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৭ সালে বায়ুদূষণের কারণে প্রায় সোয়া লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
গত ২৬ জুলাই ২০২২ বাংলাদেশ বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২ প্রণীত হয়েছে। এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। সন্দেহ নেই, মোট ৩৫ পৃষ্ঠার এই বিধিমালায় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব বিধি, উপবিধি, দফা ও তফসিল বর্ণিত হয়েছে তা কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত সমস্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে এগুলো কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে, তা চ্যালেঞ্জিং। পরিবেশ অধিদপ্তরের বর্তমান জনবল দিয়ে এগুলো সমন্বয় করা কঠিন বলেই মনে হয়। তা ছাড়া এই বিধিমালায় প্রদত্ত বিভিন্ন দূষকের সর্বোচ্চ সীমা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে। তার পরও এই বিধিমালা যতটা সম্ভব প্রয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।