আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সংস্কৃতি এবং খেলাধুলাকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান। এ নিয়ে অনেকের সন্দেহ থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। বিগত বছরগুলোতে তিনি এ দুটি খাতে যে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন, তা তার কর্মকাণ্ডে পরিলক্ষিত হয়েছে। ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি খাত থেকে তিনি অনেককে সংসদ সদস্য বানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন, এমনকি বিভিন্ন সংসদীয় কমিটিতে ক্রীড়াবিদ এবং ক্রীড়ানুরাগীদের জায়গা করে দিয়ে তিনি তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ পর্যন্ত বলেছেন যে, বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে। তার এত আগ্রহ এত প্রচেষ্টার পরও আমাদের ক্রীড়াক্ষেত্র নানা সময়ে হোঁচট খাচ্ছে। সাম্প্রতিক দু-একটি ঘটনা আমাদের জন্য বিব্রতকরও বটে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রতিটি টুর্নামেন্টের পর খেলোয়াড়দের যেভাবে সম্মানিত করেছেন, তা উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে নারী ফুটবল দল এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী দল শিরোপা জেতার পর তাদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী সম্মানিত করেছেন। তবে সরকারপ্রধানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পরও আমরা কেন বারবার হোঁচট খাচ্ছি, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত সময়কে বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালি দিন হিসেবে অভিহিত করা হয়। সে সময় ফুটবল বাংলাদেশের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত ছিল। তখন স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক ছিল। নব্বই দশকের পর থেকে বিভিন্ন কারণে ফুটবলের ঐতিহ্য ম্লান হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার নানা সময়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু একটি শক্তিশালী প্রকল্প গ্রহণ করে দীর্ঘ মেয়াদে ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটি হয়নি। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ ফুটবলের পুনর্জাগরণসহ শক্তিশালী জাতীয় ফুটবল দল গঠনের লক্ষ্যে বছরব্যাপী ফুটবল প্রতিযোগিতাসমূহ আয়োজন, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বাফুফে শক্তিশালীকরণ’। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের পুরো অর্থই ব্যয় করবে সরকার। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ফুটবল অনন্য উচ্চতায় যাবে। এ প্রকল্পের আওতায় বাফুফে প্রতি বছর ১১টি পেশাদার ফুটবল লীগ আয়োজন করবে। বাংলাদেশ ফুটবল দলের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্পসহ ১৫টি বিদেশি প্রাকটিস ম্যাচ আয়োজন করা হবে। প্রকল্পের অর্থ দিয়ে দেশের তিনটি জনপ্রিয় স্থানে তিনটি ফুটবল একাডেমি নির্মাণের কথা রয়েছে। নতুন প্রকল্পে নারী ফুটবলের উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবলের প্রশিক্ষণে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হবে। বিদেশে প্রতি বছর নারী ফুটবলারদের জন্য পাঁচটি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করা ছাড়াও প্রতিভাবান খেলোয়াড় তৈরির উদ্দেশ্যে তিনটি নারী ফুটবল লীগের আয়োজন করা হবে। এছাড়া এ প্রকল্পে আটটি বিভাগে ৬৪টি জেলাভিত্তিক ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং বিভাগ ও জেলাভিত্তিক প্রতিভা অন্বেষণ ও তিনটি বয়সভিত্তিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আয়োজন করা হবে। মূলত ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ উন্নতি করবে এমন আশায় প্রকল্পটি নেওয়া হয়। তবে দীর্ঘ সময় গেলেও প্রকল্পটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আটকে আছে। এখনো এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসেনি। আমরা আশা করব, দেশের ফুটবলের উন্নতির স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন।
এখানে একটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য প্রশিক্ষণ একটি বড় বিষয়। কিন্তু প্রশিক্ষণের জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, তা এতদিন ছিল না। এ তাড়না থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এলিট একাডেমি তৈরি করার কথা মাথায় আসে। রাজধানীর কমলাপুর স্টেডিয়ামে এ একাডেমিতে ৪২ জন ফুটবলারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এদের সবার বয়স ১৭ বছরের নিচে। সম্পূর্ণ আবাসিক সুবিধাসংবলিত এ একাডেমিতে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। সারা দেশের ৬৪ জেলা থেকে খেলোয়াড় নির্বাচন করেন কোচরা। এখানে এলে তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ সবকিছু একাডেমি বহন করে। ইতিমধ্যে আমরা ফল পেতে শুরু করেছি। ফুটবলারদের দক্ষতাও বাড়ছে। একাডেমির খেলোয়াড়রা শুধু জাতীয় দল নয়, বিভিন্ন লীগের খেলায়ও অংশ নেবেন। ঘরোয়া ফুটবলের নামকরা দলগুলো তাদের অর্থের বিনিময়ে নেবে। ইতিমধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি ফিফার টেকনিক্যাল সেন্টার (সেন্টার অব এক্সিলেন্স) তৈরির জন্য ইতিমধ্যে ২০ একর জমি হস্তান্তর করেছে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ। কক্সবাজারের রামুর খুনিয়াপালং ইউনিয়নের জঙ্গল খুনিয়াপালং মৌজার রিজার্ভ ফরেস্টের বন অধিদপ্তর কর্তৃক ২০ একর জমি বাফুফেকে হস্তান্তর করা হয়েছে। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে কক্সবাজারের এই টেকনিক্যাল সেন্টারে। বাংলাদেশ এত অল্প সময়ে সরকারি জমি দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় বাফুফে বিনা মূল্যে জমি পেয়েছে। ফুটবলের উন্নয়নে এটি অনেক বড় পদক্ষেপ।
প্রধানমন্ত্রী আমাদের ফুটবল বিশ্বকাপে খেলা নিয়ে যে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন, তা বাস্তবায়ন একেবারেই যে অসম্ভব তা নয়। কারণ বিশ্বকাপে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেশগুলো খেলে থাকে। এশিয়া অঞ্চল থেকে ইতিমধ্যে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপ খেলেছে। চীন যাবে যাবে করছে। জাপানের ইতিহাস যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখা যাবে তারা বিশ্বকাপ খেলার আগে ব্রাজিল থেকে কোচ নিয়ে এসেছে। তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে, যা জাপানের ইতিহাসে বিরল। ফ্রান্সের জাতীয় দলের অবস্থাও একই। তাদের জাতীয় দলে এমন কিছু খেলোয়াড় আছেন, যাদের জন্ম আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে। এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব হচ্ছে—বিভিন্ন দেশ থেকে খেলোয়াড় এনে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া যেতে পারে। তাদের সঙ্গে আমাদের খেলোয়াড়রা মাঠে থাকলে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হবে।
এখানে আরেকটি কথা বলতে চাই—তা হলো ফুটবলের উন্নয়নে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব ১৫ বছরের কিশোর অনেকেই আছেন। তাদের থেকে ২০ থেকে ৩০০ কিশোরকে দীর্ঘমেয়াদি ট্রেনিংয়ের আওতায় আনা যায়। কয়েক বছর পর দেখা যাবে, তাদের মধ্য থেকে ৩০ থেকে ৪০ জন খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের মূল সমস্যা হচ্ছে ফিটনেসে ঘাটতি। এটি কাটিয়ে উঠতে হলে খাদ্যাভ্যাসসহ নানা বিষয়ে জোর দিতে হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দরকার, তা হলো এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা। কারণ এর আগেও আমরা দেখেছি, বিভিন্ন টুর্নামেন্টে দল পাঠানোর বিষয়ে কিছু সরকারি কর্মকর্তার আগ্রহ ছিল। অন্তত দুটি টুর্নামেন্টে এ বিষয়ে উদাহরণ দেওয়া যায়। তবে ফুটবলের উন্নতি করতে হলে আমাদের দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকার থেকে জাতীয় বাজেটে ফুটবলের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে ফুটবলকে এগিয়ে নিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেসব দেশ বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে আসে, তাদের অনেকেই অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে আছে। এসব দেশ যদি বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ পারবে না কেন?
ফুটবল কীভাবে মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে, এবার তা দেখা যাক। আর্জেন্টাইন তারকা ফুটবলার লিওনেল মেসির কথা আমরা সবাই জানি। ১৯৮৭ সালের জুন মাসে তিনি জন্মেছিলেন এক দরিদ্র পরিবারে। ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি দুর্দান্ত নেশা ছিল তার। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি যোগ দিয়েছিলেন স্থানীয় ক্লাব রিভারপ্লেটে। কিন্তু হঠাৎ এক দুরারোগ্য ব্যাধি তার জীবন এবং ক্যারিয়ারকে হুমকির মুখে ফেলে। শরীরে হরমোনজনিত জটিলতা দেখা দেয়। স্থানীয় ক্লাব রিভারপ্লেট মেসির চিকিৎসার খরচ বহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। এই সময়ে মেসির সামনে বড় সুযোগটি আসে। স্পেনের বিখ্যাত ক্লাব বার্সেলোনা থেকে ডাক পড়ে ট্রায়ালের জন্য। প্রথম দিনই বৈতরণী পার হন তিনি। এরপর মেসির সঙ্গে বার্সেলোনা একাডেমি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে। চুক্তিটি হয় ন্যাপকিন পেপারে—যাতে মেসির চিকিৎসার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আমরা যদি ফুটবলের উন্নতি চাই এবং প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে এ খাতের সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা দরকার। খেলোয়াড়, সংগঠক, সরকারি কর্মকর্তা সবাই যদি এক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে তাহলে ফুটবলের উন্নতি হবেই। কারণ যেসব নামকরা খেলোয়াড় এখন সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তারা কেউ ভিনগ্রহ থেকে আসেনি, তারা এ গ্রহেরই মানুষ।