বাংলাদেশের জনগণকে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে কখনো সমরে, কখনো শান্তিতে, কখনো কৌশলে, কখনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদৃষ্টি দিয়ে। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়, বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু ধর্মীয় অনুভূতির ওপরে কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না; এর পরেও আবার শুরু হলো শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তাদের মাতৃভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরিকল্পনা করা হলো, যার ফলে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হলো। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে সালাম, বরকত, রফিকসহ আরও বহু ভাষাসৈনিকের প্রাণ গেল। তৈরি হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে বঞ্চিত করা হতো, যেখানে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক ও কৃষি। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়লাভের পরেও পাকিস্তান সরকার যখন জনতার রায়কে কার্যকর করল না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বাঙালিদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ, দায়িত্ববোধ, একাগ্রতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের আহ্বান জানালেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বললেন, রণকৌশলের ধারণা দিলেন, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে যখন বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর গণহত্যা চালানো হলো, ভোররাতে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি হলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগারে বন্দি। মুজিবনগর সরকার এবং বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা বিষয়ে সফল সমন্বয় বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী নেতার নেতৃত্বে থাকার ফলে সম্ভব হয়েছিল। সদ্য বিজয় লাভ করা একটি রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করল, এই দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশবিরোধী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ছিল, ফলে সীমিত অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ক্ষণস্থায়ী হলো। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করল। এতে বাংলাদেশের বিজয়ের গৌরব ম্লান হয়ে যায়, সংবিধানের চারটি মূলনীতি হুমকির মুখে পড়ে। ১৯৭৫-পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাদেশের বিজয়ের প্রকৃত ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হলো। একটি প্রজন্ম তৈরি করার চেষ্টা করা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিবর্জিত, মোহগ্রস্ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিমুখ। এটা সম্ভব হয়েছিল বিজয়ের পূর্বে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য দেশের প্রগতিশীল মানসিকতার বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন করে। ফলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা ও তাৎপর্য প্রচারের বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা ব্যাহত হয়, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির চরম উত্থান হয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি নির্বাচনে বিজয় লাভের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। মোহগ্রস্ত প্রজন্মের মোহভঙ্গ করে এবং বাংলাদেশের বিজয়ের প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে পুনরায় তুলে ধরে, ইতিহাস বিকৃতি রোধ করে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কার্যক্রম শুরু করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনে, জঙ্গি উত্থান প্রতিহত করে, সংবিধান সংশোধন করে এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পুনরায় প্রণয়ন করে নতুন প্রজন্মকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে ইতিবাচক স্বপ্ন দেখতে শেখায়। ২০০৯ সাল থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে বিজয়লাভের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে গণতান্ত্রিক চর্চায় বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে দলমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব নাগরিক মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে। এটা সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। তিনি মোহগ্রস্ত একটি শক্ত বলয় ভেঙে ফেলেন, যা দীর্ঘ ২১ বছর ধরে সৃষ্টি করা হয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ, পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস সংযোজন, খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক মানোন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নের রোল মডেলে রূপান্তর করা হয়েছে।