আজ আমি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনের এক বছরপূর্তি উদযাপন করছি। গত এক বছরে আমি এই সুন্দর দেশের অনেক জায়গা দেখতে পেরে নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি। আমি ঢাকার মনোমুগ্ধকর জায়গাগুলো ঘুরে দেখার পাশাপাশি সুন্দরবন, রাজশাহী ও কক্সবাজারের আকর্ষণীয় স্থানসমূহ দেখেছি। এই সময়ে আমার বাংলাদেশের সব বয়সি ও সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছে। আর আমি খাবার হিসেবে শিঙাড়া, বিরিয়ানি ও মিষ্টি দইকে ভালোবেসে ফেলেছি!
বাংলাদেশের কথা ভাবলেই আমার মনে একটা উপমা চলে আসে। আমি এমন একটি গাড়িতে চড়েছি, যেটা একটা সময়ের ধারা ধরে ছুটে চলছে। আমি যখন গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে তাকাই, তখন আমি অবাক হই যে, বাংলাদেশ মাত্র ৫১ বছরে কতটা এগিয়েছে। আমি এমন একটি বাংলাদেশকে দেখতে পাই যে দেশটি স্বাধীনতা ও গর্বের সঙ্গে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে এবং স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। আমি যখন উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে সামনের দিকে তাকাই, তখন আমি আগামী ৫১ বছরে বাংলাদেশ কত দূর যেতে পারে, সেটা কল্পনা করি। আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুই এখানে রয়েছে।
সামনের রাস্তা অবশ্যই মসৃণ ও সোজা নয়। এটিতে উঁচু, নিচু, গর্ত ও বাঁক সবই আছে। অন্য প্রতিটি দেশের মতোই বাংলাদেশকেও গণতন্ত্রকে লালন করতে, শাসনব্যবস্থার উন্নতি করতে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং এর জনগণকে শিক্ষিত করার পদক্ষেপ নেওয়ার সময় সব দিকে নজর রেখে এগোতে হবে।
বাংলাদেশের যাত্রাপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আসন্ন সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে পছন্দের কেউ নেই, তবে আমরা দেখতে চাই যে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। আমরা চাই, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের নিজেদের সরকার তারাই নির্বাচন করুক। গণতন্ত্রকে সমর্থন করা এবং ব্যক্তি অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পথ চলা আরো নিরাপদ, স্থিতিশীল এবং সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়তে সাহায্য করে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সরকার, মিডিয়া থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নাগরিক সমাজ থেকে রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাদের কেউ যদি নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় বা তাদের কেউ যদি অন্যকে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়, তাহলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এছাড়াও বিক্ষোভকারী, রাজনৈতিক দলগুলো, সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ প্রত্যেকের আইনের শাসনকে সম্মান করা এবং সহিংসতা, হয়রানি এবং ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও বাংলাদেশকে এর অর্থনৈতিক গতিধারা বজায় রাখতে হবে। গত ২০ বছরে দেশটিতে জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এই সংখ্যাটি প্রায় ৪ কোটি মানুষ, যারা দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে এসেছে; এটি এক কথায় অসাধারণ। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের পক্ষে অগ্রগতির এই ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব, যদি বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য যতটা সম্ভব আমন্ত্রণমূলক ব্যাবসায়িক পরিবেশ তৈরি করে।
আরো অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে যদি বাংলাদেশে নিম্নলিখিত সংস্কারগুলো ঘটে :
দক্ষ কর্মিবাহিনী গড়ে তোলার আরো ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া;
এমন একটি আইনি কাঠামো তৈরি করা, যা ব্যবসায়-সহায়ক;
দুর্নীতির কারণে গোপন খরচ (লুকানো কর!) ও অপ্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিকতা দূর করা;
সব ধরনের মেধা সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া; এবং
আরো অবাধে মুদ্রা রূপান্তরের অনুমতি দেওয়া।
এই ধরনের এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সংস্কার বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগকে উত্সাহিত করবে এবং ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশ এবং এর জনগণ এই গাড়ি সামনের দিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং আপনারাই ঠিক করবেন যে, গাড়ি কোন দিকে কোন গতিতে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র এই যাত্রায় আপনাদের সঙ্গী ছিল এবং আগামী দিনেও আপনাদের সঙ্গে পথ চলার সঙ্গী হয়ে থাকবে। আমরা আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছাতে যথাসাধ্য সাহায্য করব।
আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে এই মহান দেশে আমি আমার দায়িত্ব পালনের দ্বিতীয় বছর শুরুর এই সময়ে আমাদের যৌথ পথচলা অব্যাহত রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করছি।