নকল-ভেজাল আর নিম্নমানের ওষুধে যশোরের সাধারণ মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। চিকিৎসক, ওষুধ কোম্পানি এবং ফার্মেসি মালিকদের যোগসাজশে এই অবস্থা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চিরায়ত ইউনানি, আয়ুর্বেদ ও হার্বাল কোম্পানির পাশাপাশি অ্যালোপ্যাথিক, চীন ও জিনজিরা কোম্পানির ওষুধে যশোরের বাজার সয়লাব। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এসব অভিযোগ স্বীকার করলেও বাজার সয়লাবের অভিযোগ মানতে নারাজ। তারা বলছেন লুকিয়ে-চুরিয়ে কিছু অনৈতিক কারবার চলছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের অভাবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, একশ্রেণির চিকিৎসক অসুদপায় অবলম্বন করে অখ্যাত কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশন করছেন। এসব ওষুধের বেশির ভাগই ‘পট’ বা প্লাস্টিক কৌটার। কিছু ওষুধ আছে স্লিপ বা পাতা, বোতল এবং ক্যাপসুল ফর্মেও। যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সামনের এবং বঙ্গবাজারের কিছু ফার্মেসিতে এসব ওষুধের দেদার বিকিকিনি হয়। মূলত ফুড সাপ্লিমেন্ট হিসেবে এসব ওষুধের জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশেষত ভিটামিন, ক্ষুধামন্দা, চোখের জ্যোতি বাড়ানো, কাশি, হজমশক্তি এবং যৌনরোগের মহৌষধ হিসেবে এসব ওষুধ চিকিৎসকরাই লিখছেন। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের একজন গাইনি চিকিৎসক এবং হাসপাতাল এলাকার একটি ক্লিনিকের একজন গাইনি চিকিৎসক এসব প্রেসক্রিপশন বেশি লেখেন বলে একজন ফার্মেসি মালিক জানান। সরকারি হাসপাতালের ইন্টার্নি চিকিৎসকরাও রোগীদের এসব ওষুধ দেদারসে লিখে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, গরিবরা খুব অল্প টাকায় ওষুধ কেনেন। তাদের পুঁজি করে এসব ওষুধ লেখা ঠিক না। যতদূর জানি, আমার হাসপাতালে পট ওষুধের কারবার নেই। থাকলে উচ্ছেদ করব। নিম্নমানের ওষুধ প্রসঙ্গে বলেন, একজন ঠিকাদারের সরবরাহ করা এজমার ওষুধ বেনহাম ট্যাবলেট রং বদল পেয়েছিলাম। এতে বোঝা যায় নিম্নমানের ওষুধ বাজারে রয়েছে। তবে আমরা ট্যাবলেটটি সঙ্গে সঙ্গে ফেরত দিই। একই সঙ্গে টপ টেন কোম্পানির বাইরে টেন্ডারের ওষুধ গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছি।
বিএমএ যশোর শাখার সম্পাদক ডা. এম এ বাশার বলেন, পট কোম্পানির ওষুধের অভিযোগ আমরাও শুনি। ডাক্তারদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ছাড়া এসব ওষুধ লেখা সম্ভব না। তবে ডকুমেন্টারি কিছু পাইনি বলে কোনো ডাক্তারের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারিনি। বিএমএ সহ-সভাপতি ডা. আবু সুফিয়ান শান্তি বলেন, কপোতাক্ষ চক্ষু হাসপাতালে ডাক্তাররা পট কোম্পানির ওষুধ লিখতেন, তা বন্ধ করেছেন। এসব ওষুধের কোনো ভিত্তি নেই। এসব জিনজিরা থেকে আসে। কিছু চীনের। ওষুধের নামে এগুলো ‘আটার দলা’ ছাড়া কিছুই না।
বিএমএ সভাপতি ডা. কামরুল ইসলাম বেনু বলেন, সব চিকিৎসক যে ভালো, তা নয়। পট কোম্পানি যেন হাসপাতালে ঢুকতে না পারে, সেজন্য কর্তৃপক্ষকে বলেছি। কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং ওষুধ কোম্পানিকেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. নাজমুল হাসান বলেন, ওষুধের গুণমান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাজার থেকে উত্তোলন করে টেস্টিংয়ের জন্য নিয়মিত পাঠানো হচ্ছে। এতে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। আমরা ফার্মেসির বিরুদ্ধে আদালতে ১৬টি মামলা করেছি। এরমধ্যে ১১টির রায় আমাদের পক্ষে এসেছে।
ফার্মেসিতে অনুমোদনহীন ওষুধ না রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফার্মেসি মালিকদের বারবার বলছি ডিআরএ এবং এমএ লেখা ছাড়া, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত ক্যাশমেমো বা ইনভয়েস ছাড়া ওষুধ দোকানে না রাখার জন্য। স্বাক্ষরিত ক্যাশমেমো বা ইনভয়েস ছাড়া ওষুধ রাখার অপরাধে আমরা যেসব মামলা করছি, তাতে অসাধু কারবারীদের অপরাধ প্রমাণ করা যাচ্ছে না। পট কোম্পানির ওষুধ প্রসঙ্গে বলেন, কিছু ডাক্তার পট কোম্পানির ওষুধ লিখছেন। আমরা মোবাইল কোর্টে গিয়ে শহরের বঙ্গবাজারের দুটি দোকানে এসব ওষুধ পেয়েছি। সদর হাসপাতালের সামনের দোকানেও পাওয়া যায়। আমরা শুনেছি, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাও এসব প্রেসক্রিপশন লিখছেন। তবে সরকারি স্লিপে না লিখে সাদা কাগজে লেখেন বলে আমরা প্রমাণের অভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। সিভিল সার্জনকে মৌখিকভাবে জানিয়েছি।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন যশোর জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল হামিদ চাকলাদার ইদুল বলেন, ডাক্তাররা এসব ওষুধ লিখছেন। আমরা প্রেসক্রিপশনে এর প্রমাণ দিতে পারবো। এসব ওষুধ খেয়ে গ্রামের সহজসরল মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালককে সঙ্গে নিয়ে আমরা সিভিল সার্জনকে জানিয়েছি। তারা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এর দৌরাত্ম্য কমে আসবে।
তবে সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস এমন অভিযোগ পাওয়ার বিষয় অস্বীকার করে বলেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।