বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। এর পুনরুত্থানের আদৌ কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এখন ভোট গুরুত্বপূর্ণ নয়, মার্কা গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন দলের মার্কা নৌকা যে পাবে, চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় জয় তার অবধারিত। সুতরাং লড়াই হয় মার্কা নিয়ে। যে নৌকা মার্কা পায়, সে মার্কা পেয়েই বিজয়োল্লাস করতে থাকে। যে পায় না তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়। আবার কেউ কেউ আছেন, মার্কা না পেয়ে স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে যান। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে কখনো কখনো একক প্রার্থীকে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে অভিহিত করা হয়। কখনো কখনো তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বিএনপি এসব পাতানো নির্বাচনে অংশই নিচ্ছে না। তার পরও কেউ যদি স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে যান, তবে তাকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এখন নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। সে ক্ষেত্রে মারামারি, হানাহানি, খুনখারাবি অবিরাম ঘটছে। দু-চারজন নিরীহ লোকের প্রাণ গেলে কার কী আসে যায়! ও রকম খুনে মামলা-টামলাও খুব একটা হয় না। হলেও তদন্ত হয় না। তদন্ত হলেও বিচার হয় না। হয়তো ‘নির্দোষ’ আসামিরা বছরের পর বছর কারাগারে থাকেন। কে কার খবর রাখে। এ হচ্ছে নির্বাচনের খবর। এটি শুধু শেখ হাসিনার আমলে নয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশে একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানও সংসদের ৩০০ আসনেই জয়লাভ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল প্রায় ৭০টি আসনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। রেডিও-টেলিভিশনে নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এই পরিস্থিতিতে কিছুক্ষণ পরেই আবার সংশোধিত বিজয়ীর তালিকা প্রকাশ করা হয়। তাতে সারা দেশে তুমুল প্রতিবাদ শুরু হয়। কিন্তু সরকার দমননীতির মাধ্যমে সে প্রতিবাদ স্তব্ধ করে দেয়।
১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালের নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন ছিল না। আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়। জেনারেল ওসমানী কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরে নির্বাচন পরিস্থিতি দেখেন। শুধু আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিকরাও জেনারেল ওসমানীকে সমর্থন করেন। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন শেষে জেনারেল ওসমানী সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন- তাতে তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা তার কানে কানে বলেন, তিনি যেন বলেন যে, নির্বাচনে প্রচুর কারচুপি হয়েছে। এতে রেগে গিয়ে জেনারেল ওসমানী বলেন, আমার মুখে আপনাদের কথা গুঁজে দেয়ার চেষ্টা করবেন না। আমি দেখেছি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগাররা জেনারেল ওসমানীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ওসমানী সেসব ক্ষোভের দুই পয়সারও মূল্য দেননি। নির্বাচনে বিজয়ের জন্য তিনি বিচারপতি সাত্তারকে অভিনন্দন জানান। এত গেল স্বাধীনতার পরপর নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন নেই। ২০০১ সালের নির্বাচন নিয়েও না। কিন্তু ২০০৮ সালে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শামসুল হুদা কমিশন একেবারে কাছা দিয়ে নেমেছিলেন বিএনপিকে হারিয়ে দিতে। সে নির্বাচনে কোন আসন থেকে কাকে নির্বাচন করা হবে তার একটা নীলনকশা আগে থেকেই নির্ধারণ করা হয় এবং সে অনুযায়ী ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়ী করে আনা হয়।
শেখ হাসিনা ১/১১-এর সামরিক সরকারকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, আপনারা বিএনপিকে আচ্ছাছে মার দেন। আমরা যদি ক্ষমতায় আসতে পারি তাহলে আধা সংশোধন করে আপনাদের দায় মুক্তি দেয়া হবে। ১/১১-এর সরকার নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। তাতে খুশি হয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছিলেন, এই সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে জেনারেল মইনউদ্দিন আহমেদ তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। এমনিতেই তিনি ছিলেন চূড়ান্ত ভণ্ড ও অযোগ্য। তিনি চেয়েছিলেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে হোন, তাকে যেন প্রেসিডেন্ট পদটি দেয়া হয়।
শোনা যায়, এই জন্য তিনি ভারতের সাথে দহরম মহরমও করেছিলেন। কিন্তু শামসুল হুদার তত্ত্বাবধানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল- সেটি আজকাল কমই উচ্চারিত হয়। ২০১৪-২০১৮ সালে তো বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি। শামসুল হুদা কমিশন নীল নকশার নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে আনার জন্য হেন কোনো অপকর্ম নেই যা করেনি। তার অন্তরে কি আশা বা লোভ ছিল, তা বলতে পারি না; কিন্তু যখন দেখা গেল বেছে বেছে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হারিয়ে দেয়া হয়েছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদের ঢেউ উঠল।
বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয়া ব্যালটের মুড়ি উদ্ধার করে সাংবাদিকদের দেখালেন। কেন্দ্রের বাইরে এ রকম হাজার হাজার মুড়ি পাওয়া যাচ্ছিল। এর মানে হলো নির্ধারিত প্রার্থীর পক্ষে শত শত ব্যালট পেপার ছিঁড়ে ভোটের বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব ব্যালটের হিসাব তখন মিলত না। একটি মুড়ির ঘটনা তদন্ত করলেই কতটা জাল ভোট পড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যেত। জাল ভোটের কারণে সে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যখন হাজারে হাজারে মুড়ি উদ্ধার হচ্ছিল, তখন শামসুল হুদা এক এলান জারি করলেন যে, এখন থেকে যার কাছে মুড়ি পাওয়া যাবে, তাকেই গ্রেফতার করা হবে। যেকোনো শিশু বুঝবে যে, এই ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল তার নির্বাচনের জালিয়াতি প্রকাশ না হয়ে পড়ে। অভিভাবকরা বললেন, কোনো শিশু যদি স্কুলের পেছন থেকে খেলতে গিয়ে ওই মুড়ি কুড়িয়ে পায়, তবে কি তাকেও জেলে পোরা হবে? কোনো পান দোকানদার যদি ওই মুড়ি দিয়ে পানের খিলি বানিয়ে বিক্রি করে, তবে কি তাকেও হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে কোমরে দড়ি দিয়ে জেলে নিয়ে যাওয়া হবে। হয়তো তাই হবে। শামসুল হুদা নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের কোনো জবাব দেয়নি। সেই জালিয়াতির নির্বাচনে ২০০-এর বেশি আসানে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল।
শেখ হাসিনা সেনাপ্রধান মইনউদ্দিন আহমেদকে যে কথা দিয়েছিলেন, তার অনেকটাই তিনি রেখেছিলেন। তিনি সেনা অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সবাইকে দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। তাদের একজন তো (সাবেক রক্ষী বাহিনী) জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার নিযুক্ত ছিলেন। ক্ষমতায় এসে দফায় দফায় তার চাকরির মেয়াদ বাড়ান। এই গেল সেই সময়কার চিত্র। জেনারেল মইনউদ্দিন আহমেদ বোনম্যারোর জটিল রোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক। সামরিক সরকার নিয়োজিত ফখরুদ্দীন আহমদ যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক। সাবেক সিইসি শামসুল হুদা এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন। কেউ পোছেও না।
এরপর নুরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত হলো আজব এক নির্বাচন কমিশন। তাদের না ছিল কোনো সততা, না ছিল কোনো যোগ্যতা, না ছিল মেরুদণ্ড। তাদের অধীনে ২০১৪ সালের নির্বাচন নামক প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। যে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ প্রধান দলগুলো। একমাত্র মাহবুব তালুকদার ছাড়া কমিশনের সবাই ছিলেন বলতে গেলে কৌতুক অভিনেতা, সরকার যেভাবে নির্দেশ করত, তারা সেভাবেই কাজ করত। ভোটের কোনো বালাই ছিল না। ভোটারদের কেন্দ্রের কাছেও আসতে দেয়া হয়নি। আগের রাতেই পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে সরকার ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছিল। ইতোমধ্যে সরকার আইন করে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে। এ এক নিকৃষ্ট ব্যবস্থা। ফলে ইতঃপূর্বে যোগ্য প্রার্থীদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচিত করে আনার যে সুযোগ ছিল, তা-ও তিরোহিত হয়ে যায়। নির্বাচন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হারিয়ে গেল। দেশকে ক্রমেই একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হলো। সে ধারা চলছেই।
২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন অনুষ্ঠিত হলো তা-ও হলো একই ধারায়। পণ্ডিতেরা বলছিলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি বড়ো ভুল করেছিল। সে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল। তাতেও যে ফলাফল শূন্যই হতো, তা ওই পণ্ডিতদের বোঝানো যাচ্ছিল না। সে কারণেই হোক কিংবা পরীক্ষা করার জন্যই হোক ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল। তারা জিতেছিল চারটি আসনে। কিন্তু তার মধ্যে ছিলেন দুই টোকাইও। এক টোকাই আওয়ামী লীগ থেকে উষ্ঠা খেয়ে বিএনপিতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল, আর একজন নাম না জানা লোক কখনো বিএনপি করেনি, মোহাম্মদ মনসুর আওয়ামী লীগ থেকে টিকিট পাননি। বিএনপি থেকে জয়ী হয়ে এখন শুনি সংসদে বিএনপির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন।
আর এক ব্যক্তি, লন্ডন থেকে এসে ডক্টর কামাল হোসেনের তদবিরে নমিনেশন পেয়েছিলেন। তিনি যে কে, তা বোঝা যায় না। তবে বিএনপি মাত্র চারটি আসন পাওয়ায় (দুই টোকাইসহ) সেই পণ্ডিতদের মুখ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। তারা আর বলতে পারবেন না যে, অমুক নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি মারাত্মক ভুল করেছে।
এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাবেক আমলা হাবিবুল আউয়াল। প্রথম প্রথম বেশ মিষ্টি কথাই বলছিলেন; কিন্তু কুমিল্লার মেয়র নির্বাচন ও বেশ কিছু কাউন্সিলর নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেল, তিনি তার ইমামদের পথ অনুসরণ করেছেন। কেবল নিচে গিয়ে রাস্তায় স্লোগান দিতে পারছেন না যে, নৌকা মার্কায় ভোট চাই।
অতএব, ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়ার কোনো মানেই হবে না। বিএনপিকে হয়তো দু-চারটা আসন দিয়ে বাকি সব আওয়ামী ঝোলায় তুলে দেবেন তিনি। ফলে বিএনপি বলছে এই সরকারের অধীনে তারা আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকার চাই- এইটাই তাদের দাবি।
এই দাবি ন্যায়সঙ্গত, কারণ আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতির কবর দিয়ে এখন মার্কার রাজনীতি চালু করেছে। এ দেশ জনগণের; সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভোটের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। সেটি কিভাবে সম্ভব, তা আমার অন্তত জানা নেই।