বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উল্লেখযোগ্য ভুক্তভোগী দেশ। অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান নিম্ন বদ্বীপ অঞ্চলে হওয়ার কারণে আমাদের দেশে বিভিন্ন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা যেমন—নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, ঝড়, বন্যা, আকস্মিক বন্যা, খরা ইত্যাদির পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে, যা মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জার্মান ওয়াচের বৈশ্বিক ঝুঁকিসূচক (জানুয়ারি, ২০২১) অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। অথচ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা অতি নগণ্য। বিশ্বব্যাংকের (ক্লাইমেট ওয়াচ ২০২০) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু কার্বন নিঃসারণের পরিমাণ মাত্র ০ দশমিক ৬ মেট্রিক টন। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু কার্বন নিঃসারণের পরিমাণ ১৪ দশমিক ৭ মেট্রিক টন ও তেলসমৃদ্ধ কাতারের মাথাপিছু কার্বন নিঃসারণের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩২ দশমিক ৫ মেট্রিক টন।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের গ্রাউন্ডসওয়েল রিপোর্টের প্রথম (২০১৮) এবং দ্বিতীয় (২০২১) প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চঝুঁকির কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ স্থানান্তরিত হতে পারে। এছাড়াও ৩৫ মিলিয়ন উপকূলীয় জনগোষ্ঠী এখনো মারাত্মক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মতো বসবাস করছে।
তবে আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি মিশরের শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৭) প্রথম বারের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোর সহায়তার জন্য ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিলের গঠনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন বিশ্বনেতারা। জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দাবি অবশেষে মেনে নিয়েছেন কার্বন নিঃসারণকারী শিল্পোন্নত দেশসমূহের নেতারা, যা এবারের সম্মেলনের আপাতত বড় অর্জন।
দুই সপ্তাহব্যাপী ব্যাপক দরকষাকষি ও জলবায়ু আলোচনার পর, শার্ম আল-শেখ বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির অর্থায়নসুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চুক্তি অনুসারে, প্রাথমিকভাবে সব উন্নত দেশ, তাদের সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিলে অর্থ প্রদান করবে, যা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজে লাগাবে।
এই তহবিলে কোন দেশ কীভাবে কী পরিমাণ অর্থ দেবে, সেসব বিষয়ে এবারের সম্মেলনে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২০২৩ সালের নভেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কপ-২৮ সম্মেলনের জন্য। তবে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের (জিসিএফ) মতো এই তহবিলও যেন কাঠামোগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার বাধায় না পড়ে, সেটাই দেখার বিষয়।
এছাড়া কপ-২৭ সম্মেলনে স্থানীয় নেতৃত্বে অভিযোজন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু কার্যক্রমে অর্থায়নের বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে; কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি এবারের সম্মেলনেও পূরণ হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ নিয়ে চুক্তির ব্যাপারে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এবারের জলবায়ু পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা এবং সাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে শিশু ও যুবকদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জলবায়ুনীতি এবং কর্মের নকশা ও বাস্তবায়নে সব দেশকে শিশু ও যুবকদের অন্তর্ভুক্ত করতে উত্সাহিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ অভিযোজনের দিক দিয়ে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অভিযোজন কৌশল ও অনুশীলন সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জলবায়ু বিপদাপন্ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এখানকার স্থানীয় অভিযোজন ব্যবস্থাগুলো খুব কাজের। এক সময় ঘূর্ণিঝড়ে লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হতো; কিন্তু এখন ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাসব্যবস্থা, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ফলে মৃত্যুর পরিমাণ খুব কমে এসেছে। নিজস্ব অর্থায়নে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা—ব্র্যাক বাংলাদেশে জলবায়ু অভিযোজন বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার দিক দিয়ে অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে। সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন জলবায়ু বিপদাপন্ন এলাকায় স্থানীয় নেতৃত্বে অভিযোজন কার্যক্রমে কার্যকরী ও টেকসই উপায়ে কাজ করছে। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা কৃষকদের সহায়তার লক্ষ্যে ‘অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক’ মডেল তৈরি করেছে ব্র্যাক, যার মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষকদের অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট মোকাবিলায় সর্বোত্তম ও টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পদ্ধতিতে কাজ করছে ব্র্যাক। উন্নতমানের ও স্বল্পমূল্যের ফিলটার সংযুক্ত এই মডেলের মাধ্যমে নিরাপদ পানির নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির এই ফিলটার ০ দশমিক ৫ মাইক্রোন সাইজের ব্যাকটেরিয়া প্রতিহত করতে সক্ষম।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় স্থানীয় মানুষকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষই জানে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো যায়। এক্ষেত্রে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জলবায়ু বিপদাপন্ন অন্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। সেজন্য স্থানীয় নেতৃত্বে অভিযোজনের ক্ষেত্রে তাদের সমন্বিত সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
এখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলার জরুরি অবস্থা চলছে। আমাদের দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রতিটি মানুষের উচিত জলবায়ুযোদ্ধা হিসেবে কাজ করা। বলা বাহুল্য, কপ-২৭-এর অঙ্গীকারসমূহ পূরণে সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করলে বিশ্বের জলবায়ু জরুরি অবস্থা মোকাবিলা সম্ভব হবে।
কার্বন নিঃসারণকারী উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি মতো ক্ষতিপূরণ দিতে আন্তরিক হলে অভিযোজন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কার্যকর অভিযোজন নিশ্চিত করতে এবং ভুল অভিযোজন এড়াতে এখন বিশ্বব্যাপী স্থানীয় নেতৃত্বে অভিযোজন উদ্যোগের প্রয়োজন।