প্রথম অধ্যায়: ২০২৪ পতনের দিন – প্রথম পর্ব: খবরটি যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে
এএফপি-র খবরটি যখন বের হয়, তখনই তা সন্দেহজনক মনে হয়নি। কিন্তু পরে মনে প্রশ্ন জাগে- সেনাপ্রধানের ভাষণের আগেই এএফপি-র প্রতিবেদক কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলেন। এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) কিছু কর্মকর্তা গণবিক্ষোভের পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শফিকুল আলমের, যিনি তখন এএফপি-র প্রতিবেদক, তার প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগের ভিত্তিও অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট সোমবারের সকাল- যুক্তরাজ্যে আরেকটি কর্মময় সপ্তাহের শুরু। কিন্তু কয়েক হাজার মাইল দূরে আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ তখন উত্তপ্ত। রাজধানী ঢাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরমে। আগের দিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা গণ-আন্দোলনের ডাক জোরদার করায় ঢাকা, সব বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এবং সকল সিটি কর্পোরেশনে সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছিল।
সকাল নাগাদ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে হাজার হাজার ছাত্রজনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের দিকে প্রবল ঢলের মতো এগিয়ে চলেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়েই তারা প্রকাশ্যে কারফিউ অমান্য করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আরও উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরছিল: শত শত লোক পায়জামা পরে ও টুপি মাথায় মারাত্মক অস্ত্র হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাসভবন সুধা সদনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এত বিশাল ও মারমুখি জনস্রোত কীভাবে কারফিউ এবং শহরের প্রবেশপথে স্থাপিত নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভাঙ্গতে পারলো!তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হলো, কিছু একটা মারাত্মক গড়বর হচ্ছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ২০১৩ সালের ৫ই জুন নিরাপত্তা কর্মীরা কীভাবে হেফাজতে ইসলামের একটি কট্টরপন্থী আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করেছিল। তখন পুলিশ, র্যাপিড অ্যাক্সন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু এবার এমন কোনোকিছু ছিল না। বরং খবর আসছিল যে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে বিনা বাধায় এগিয়ে যাচ্ছে।
সংকটে উত্তরের সন্ধানে
ক্রমবর্ধমান সংকট সম্পর্কে জানতে আমি ঢাকায় উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। প্রধানমন্ত্রীর নবনিযুক্ত প্রেস সেক্রেটারি নাঈমুল ইসলাম খানকে ফোন করলাম। একবার রিং বাজতেই কলটি কেটে গেল। উত্তরের জন্য মরিয়া হয়ে আমি এরপর তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদকে ফোন করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাউকেই ফোনে পাওয়া গেলো না। এতে আমার উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল। এর কিছুক্ষণ পরই বাংলাদেশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর এলো: দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দুপুর ২টায় টেলিভিশনে জাতির উদ্দ্যেশে ভাষণ দেবেন। এই ঘোষণা আমাকে আরও গভীর উদ্বেগে ফেলে দিল। এটি ছিল অত্যন্ত অস্বাভাবিক— দেশ ও জাতির চরম সংকটের সময় সাধারণতঃ রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেন, সেনাপ্রধান নন। এবার তিনি কেন?
প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি, কমন্স সভার সামনে বিক্ষোভ
আমি প্রকৃত ঘটনা জানতে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। ঢাকায় আমার অন্যান্য সূত্রের সাথে যোগাযোগ করলাম। অবশেষে আমি প্রধান তথ্য কমিশনার আব্দুল মালেকের সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম, যিনি বহু বছর ধরে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সচিব এবং তথ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার উত্তর ছিল সংক্ষিপ্ত: “একজন সিনিয়র কূটনীতিক এবং সাংবাদিক হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন যে আমাদের মতো দেশে যখন সেনাপ্রধান কথা বলেন, তখন নিঃসন্দেহে তা একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিরই ঈঙ্গিত করে।” তার কথা আমার সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কাকে নিশ্চিত করলো।
লন্ডনে আমাদের বাসায় আমার স্ত্রীও আমার মতোই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁকে যুক্তরাজ্যের একটি কলেজের একজন ছাত্র, যিনি বাংলাদেশের এক উর্ধতন সেনা কর্মকর্তা ছেলে (নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম গোপন করা হয়েছে), জানালো যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। দুপুরের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শেখ হাসিনার পরিণতি নিয়ে তীব্র জল্পনা-কল্পনা এবং গুজবে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল।
গণভবনে হামলা এবং সেনাপ্রধানের বিলম্বিত ভাষণ
খুব শীঘ্রই খবর নিশ্চিত হলো যে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে ব্যারিকেড ভেঙে গণভবন এবং সংসদ ভবনে প্রবেশ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। আমরা অধীর আগ্রহে সেনাপ্রধানের ভাষণের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, যা প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টায় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু পরে বিকেল ৪টায় পিছিয়ে নেয়া হয়।
এদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এএফপি-র ঢাকা ব্যুরোর বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর জানালো। এএফপি প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছিল: “তিনি এবং তার বোন গণভবন (প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন) ছেড়ে একটি নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। তিনি একটি ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেই সুযোগ পাননি।” (এএফপি ৫ আগস্ট ২০২৪, বিকেল ৩টা)
সেই মুহূর্তে আমি এএফপি-র এই খবরটির সময় নিয়ে কোনো সন্দেহ করিনি। কিন্তু পরে মনে হলো সেনাপ্রধানের ভাষণের আগেই এএফপি-র প্রতিবেদক কীভাবে এই তথ্য পেলেন, বিশেষ করে যখন প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন? পরেই এর পূর্ণ তাৎপর্য আমার কাছে স্পষ্ট হলো: এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তা এবং গণবিক্ষোভের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে একটি স্পষ্ট যোগসূত্র নির্দেশ করে, যারা সরকারি চাকরির কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আড়ালে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার সুক্ষ পরিকল্পনা করেছিল।
পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে শফিকুল আলমের নিয়োগের পেছনের কারণগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলম তখন এএফপি ঢাকা ব্যুরো প্রধান ছিলেন। তিনিই অন্য কোনো সংবাদ মাধ্যমের আগে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরটি চাঞ্চল্যকরভাবে প্রকাশ করেছিলেন। এটি সাধারণ দৃষ্টিতে একজন সাংবাদিকের জন্য এক অসাধারণ কৃতিত্বের বিষয়। কিন্তু পটপরিবর্তনের পর প্রেস সচিবের পদ পাওয়া এবং সবার আগে শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের খবর পাওয়ায় মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্রেরই প্রমাণ দেয়, আর তা স্পষ্টতই একজন সাংবাদিকের পেশাদারি যোগসূত্র নয়- বরং শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের সুগভীর ষড়যন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এটাই জোর দিয়েই বলা যায়। আর এই নিবিড় যোগসূত্রের ফলেই চরম অস্থিরতা এবং কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যখন অত্যন্ত কঠিন ছিল, তখন শফিক দুনিয়া কাঁপানো একটি স্কোপ নিউজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
একটি পরিচিত মুখ
শফিককে আমি দীর্ঘকাল ধরে চিনতাম। আমরা বেশ কয়েক বছর একসাথে ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ এবং পরে ‘ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’-এ একসঙ্গে কাজ করেছি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান ইংরেজি দৈনিক ‘বাংলাদেশ অবজারভার’-এর একজন বিজনেস রিপোর্টার ছিলাম। তখন আলম ছিলেন একজন জুনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার। তিনি কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। কিন্তু শফিকের অনুযোগ ছিলো পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদক তার কাজের সঠিক মূল্যায়ন করছেন না। প্রখ্যাত ক্রিকেটার রকিবুল হাসানের ভাই রউফুল হাসান তখন অবজারভারের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। ইকবাল সোবহান চৌধুরী ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক কে.এম.এ. মুনীম ছিলেন সম্পাদক। তবে আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিকদের বিশিষ্ট নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তার প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়। তার সাথে আমার সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। এ কারণেই হয়তো শফিক মাঝে-মধ্যে আমার কাছে তার অভিযোগগুলো নিয়ে কথা বলতেন।
সাংবাদিকায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা
অনেকের মতো আমার কর্মজীবনও বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে প্রভাবিত। বিএনপি সরকারের আমলে ‘দৈনিক জনতা’ থেকে আমাকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়। এটি ছিল আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিকদের বরখাস্তের অংশ, যার মধ্যে আহমেদ জুবায়ের (যিনি পরে একজন বিশিষ্ট টিভি সাংবাদিক এবং সময় টিভির সিইও হন), মুজতবা দানিশ, শহিদুজ্জামান লিটু (নিউজ নেটওয়ার্কের সিইও ও সম্পাদক), খায়রুজ্জামান কামাল এবং সুনীল শুভ রায় (যিনি পরবর্তীতে এইচ এম এরশাদের প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মালিকানাধীন ‘দৈনিক জনতা’ একসময় সম্পাদক সানা উল্লাহ নূরী-র অধীনে পেশাদারিত্বের একটি উদাহরণ ছিল। সানা উল্লাহ নূরী ছিলেন বাংলাদেশি সাংবাদিকতায় এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে পেশাদারিত্ব এবং সাংবাদিকদের অধিকারকে সবসময় সমুন্নত রাখতেন। এরশাদ সরকারের আমলে যখন সাংবাদিকরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন, সানা উল্লাহ নূরী তখন সংহতি প্রকাশ করে জনতা-র সাংবাদিকদের কর্মসূচিতে যোগদানের অনুমতি দিয়েছিলেন। এমনকি ধর্মঘটের সময় সংবাদপত্রটি বন্ধ রেখেছিলেন। তার পেশাদারি সততা ও সাহসিকতার অঙ্গীকার দৈনন্দিন কাজেও প্রতিফলিত হয়েছিল।এর একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। একবার জনতার সাংবাদিকদের নিয়মিত সম্পাদকীয় দিকনির্দেশনামূলক বৈঠকে সানা উল্লাহ নূরী বলেছিলেন, এরশাদ যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে কথা বলবেন, তখনই কেবল এটি প্রধান খবর হবে। অন্যথায়, তার খবর থাকবে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পরে। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির অবস্থান ছিলো ঐ প্রধান দুই দলের পর। এই অনন্য পেশাদার নেতৃত্ব সানা উল্লাহ নূরীকে প্রতিভাবান ও পেশাদার সাংবাদিকদের দৈনিক জনতায় একত্রিত করতে সক্ষম করেছিল।ফলে এরশাদের পতনের পর যখন কিছু সংবাদপত্র অফিসে হামলা হয়েছিলো, জনতায় তেমন হয়নি।
তবে এরশাদের পতনের পর তার এক আত্মীয় আসাদ (যার নাম আমি ভুলে গেছি, তবে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং এরশাদের পতনের পর চাকরি হারান), দৈনিকটির সম্পাদক নিযুক্ত হন। জনতার মধ্যে থাকা বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাংবাদিকদের পরামর্শে তিনি জামায়াত-সমর্থিত বিএনপি সরকারের সাথে একটি বোঝাপড়া করেন। এর ফলে আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হয় এবং এর প্রতিক্রিয়া এড়াতে লে-অফ ঘোষণা করা হয়। আমাদের সমর্থনকারী অনেক সাংবাদিক আমাদের চাকরিচ্যুতি এবং লে-অফ প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন।
জনতা কর্তৃপক্ষ বিএনপিপন্থী সাংবাদিক নেতা আমানুল্লাহ কবির এবং জনতা-র মধ্যে তার ঘনিষ্ঠ অনুসারি—শামসুল হক, রোজি ফেরদৌস এবং মাহবুব মুরশেদ—এর মতো বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাংবাদিকদের যোগসাজসে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরীর কাছে তার পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করে আমাদের আন্দোলন বন্ধ করার জন্য সহায়তা চেয়েছিল। এরপর এক রাতে যখন আমরা এম শাহজাহান মিয়া এবং আব্দুল কালাম আজাদের মতো অন্যান্য সাংবাদিক নেতাদের সাথে জনতার তেজগাঁও প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন বিএনপি-জামায়াতের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আমরা পরে জানতে পারি যে রোজি ফেরদৌস এবং আমানুল্লাহ কবির ঠিক সেই মুহূর্তে তেজগাঁও থানায় উপস্থিত ছিলেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং আমাদের বিতাড়িত করার জন্য পুলিশের সমর্থন নিশ্চিত করছিলেন। নিরাপত্তার জন্য সংবাদপত্র প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। এরপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জনতা আমাদের বাদ দিয়েই পুনরায় চালু হয়। আমাদের সমর্থনকারী সাংবাদিকদের অনেকে পদত্যাগ করেন- কেউ কেউ বরখাস্ত হন।
নতুন করে শুরু এবং পরিচিত মুখ
এই অস্থির ঘটনার পর আমি ১৯৯৬ সালে ‘বাংলাদেশ অবজারভার’-এ যোগদানের আগে কয়েক মাস একটি শেয়ারবাজারের সাপ্তাহিকীতে কাজ করি। অবশেষে ২০০১ সালে আমি অবজারভার ছেড়ে বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিএসএস)-এ যোগ দেই। অবজারভার ছাড়ার পর শফিকের সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখা হওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ২০০২ সালে ‘ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’-এ ভাগ্য আমাদের আবার সহকর্মী হিসেবে একত্র করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে আমাকে এবং আরও আটজনকে বাসস থেকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করার পর আমি ‘ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’-এ যোগ দেই। শফিকও ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ ছেড়েছিলেন কারণ মালিকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধের কারণে সংবাদপত্রটি একটি দীর্ঘ আর্থিক সংকটে ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ‘এক্সপ্রেস’-এর সম্পাদক, প্রখ্যাত সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন একবার আমার কাছে শফিকের প্রশংসা করে বলেছিলেন, শফিক ভালো ইংরেজি লেখে।”
পরবর্তী পর্বঃ ১৫ জুন ২০২৫: পতনের দিন – দ্বিতীয় পর্ব – লন্ডন দূতাবাসে ঘোষণা এবং তার পরের ঘটনা
অনুবাদ-মতিয়ায় চৌধুরী