‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’- প্রায় সমান গতিতে দুটি ছবি ঝড় তুলেছে দেশের প্রেক্ষাগৃহে। করোনা, প্রেক্ষাগৃহের অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাই সিনেমা ছিল স্থবির। এতে আটকে যায় বড় বাজেটের প্রায় দেড় ডজন সিনেমা। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দর্শক আসবেন কি না, এমন শঙ্কায় সিনেমা মুক্তি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন পরিচালকরা। গত ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘শান’ ও ‘গলুই’ দিয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায় দেশীয় সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানোর। এরপর ঈদুল আজহায় বাংলা সিনেমা নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনা তৈরি হয়। ঈদের তিন ছবি দেখতে বন্ধুবান্ধব ও পরিবার নিয়ে ভিড় করতে থাকেন দর্শক। মুক্তির পর হাওয়া তৈরি করে বাংলা সিনেমার নতুন রেকর্ড। মুক্তির আগেই সিনেমাটির অগ্রিম টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্সে প্রথম দিনের টিকিট বিক্রি হয়ে যায়, বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকের ব্যাপক আগ্রহের কারণে বহুল আলোচিত একটি হলিউডি ছবির প্রদর্শনী স্থগিত করা হয়। যা প্রযোজক ও পরিচালকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। যাঁরা এত দিন সিনেমা মুক্তি দিতে ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁরা নড়ে চড়ে বসেছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচালক তাঁদের ছবির মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই-ই নয়, দ্রুত শ্যূটিং শেষ করে সেন্সর বোর্ডে ছবি জমা দিচ্ছেন কোনো কোনো পরিচালক।
এদিকে নতুন পরিচালকেরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বড় পর্দার চ্যালেঞ্জ নিতে। পরাণ ও হাওয়ার সাফল্যে ছোট পর্দার বেশ কয়েকজন সিনেমা তৈরির ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। একের পর এক ছবি মুক্তির ঘোষণাকে ভীষণ ইতিবাচকভাবে দেখছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। অনেকে বলছেন, বাংলা সিনেমার চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। তবে এই যাত্রা অব্যাহত রাখতে সতর্ক থাকতে হবে। পরপর ভালো ছবি না দিলে দর্শক আবার হলবিমুখ হতে পারেন। দর্শক যে হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখতে এভাবে আগ্রহী হয়ে উঠবেন, সেটা কেউ ভাবতে পারেননি। ভালো সিনেমা দেখতে যে একদিন দর্শকের জোয়ার উঠবে, এমন প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এত দ্রুতই যে দর্শকের জোয়ার উঠবে, বোঝা যায়নি । আমাদের তরুণেরা হলে গিয়ে ভালো সিনেমা দেখতে চান। পরাণ ও হাওয়া তার প্রমাণ। দেশীয় সিনেমার কারণে বিদেশি সিনেমাও নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে হল কর্তৃপক্ষ। এটা প্রমাণ করে যে দেশীয় সিনেমার সম্ভাবনা কত বেশি। এ কারণে সিনেমা মুক্তি দিতে প্রযোজক-পরিচালকদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। হলে দর্শক আসা শুরু হয়েছে। তাঁদের যে ভালো সিনেমা দেখার ক্ষুধা আছে, তা পরাণ দিয়েই টের পাওয়া।
পরাণ-এর পর কাছে দর্শকদের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। পরের ছবিতেও কি সেই ধারাবাহিকাতা থাকবে? চলচ্চিত্রে দর্শক খরা চলছিল। কয়েকটি মৌলিক সিনেমার কারণে আবারও দর্শক হলে আসছেন। দর্শকের দেশীয় সিনেমা দেখার অভ্যাস ধরে রাখতে একের পর এক ভালো সিনেমা দরকার। সে ভাবনা থেকেই ছবিগুলো মুক্তি দিতে হবে। তবে কেবল একের পর এক ছবি মুক্তি পেলেই হবে না, ভালো গল্প, ভালো নির্মাণের দিকে জোর দিতে হবে। ভালো গল্প, ভালো নির্মাণ হলে দর্শক হলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন, এটাই স্বাভাবিক। দেশে সিনেমার প্রচুর দর্শক আছে। ভালো সিনেমার অভাবে দর্শকের আকাল তৈরি হয়েছিল। এখন দর্শক ফিরেছেন। দর্শক রাখতে হলে মাথায় রাখতে হবে গল্প ও নির্মাণটা যেন ঠিকঠাক থাকে।
বাংলাদেশে এবারের ঈদের মাসে মুক্তি পাওয়া তিনটি সিনেমা- পরাণ, হাওয়া আর দিন দ্য ডে নিয়ে দর্শক আগ্রহ বেড়েই চলেছে। সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হলগুলোতে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক ভিড়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাইরে পর্যাপ্ত হল না থাকার কারণে সিনেমাগুলো নিয়ে আগ্রহ মূলত ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ। চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, নির্মাতা ও দর্শকরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে এমন আগ্রহ দেখা গেছে। কিন্তু পরে তা ধারাবাহিকভাবে ঘটতে দেখা যায়নি। তারা মনে করছেন, এবার এক সাথে তিনটি ছবি মুক্তি পাওয়াতেই দর্শকের আগ্রহটা আবার ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ তিনটি ছবিই বাংলাদেশি সিনেমার কথিত সুদিন- অর্থাৎ হল-ভর্তি দর্শক কিংবা টিকেটের জন্য কাড়াকাড়ি-এমন দৃশ্য দেখার মতো পরিস্থিতি তৈরি করবে কিনা- তা বলা কঠিন বলেই মনে করছেন তারা। কারণ হিসেবে এই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মানসম্মত সিনেমা হলের সংখ্যাই আছে হাতে গোনা কয়েকটি। আবার বিনিয়োগ সংকটের পাশাপাশি সিনেমার গল্প তৈরিতেও আছে নানা ধরণের বাধা-বিপত্তি।
আলোচিত তিনটি ছবিতে বিনোদনের সব উপাদান যেমন আছে তেমনি গল্পও ভালো। আবার ছবি বানানোর মানও এখন অনেক ভালো হয়েছে। যা দর্শকদের ভালো লেগেছে। ছবিগুলোর টিকেট পেতে দর্শকদের কষ্টই হয়েছে। তবে বাংলা সিনেমা নিয়ে ভয় কেটে গেছে বলা যায়। হলগুলো ভালো হলে আর সিনেমা মোটামুটি হলেও নিয়মিতই সিনেমা দেখবেন দর্শক। পরিবেশটা ভালো পেলে তো নিয়মিত হলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন। প্রসঙ্গত, পরাণ, হাওয়া আর দিন দ্য ডে- তিনটি সিনেমাই চলচ্চিত্র রিলিজের যে প্রথাগত ধাপগুলো অর্থাৎ পোস্টার, ট্রেলার এবং পরে রিলিজ- সব ধাপেই ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে সিনেমাগুলো দেখতে সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স ছাড়াও সিনেমা হলগুলোতে ভিড় করছে মানুষ। এমনকি অনেক বছর পর এবার এই তিনটি বাংলাদেশি সিনেমারই অগ্রিম টিকেট কিনতে দেখা গেছে দর্শকদের। ঢাকার প্রচলিত ধারার সিনেমা হলগুলোর অনলাইনে টিকেট বিক্রির সুযোগ না থাকায় ঢাকার কয়েকটি হলের কাউন্টার থেকেই অগ্রিম টিকেট সংগ্রহ করেছেন দর্শকরা। হল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, পরাণ ও হাওয়া সিনেমা দুটির মাধ্যমে তারা আবার নাইট শো চালু করেছেন- যা দর্শকের অভাবে প্রায়শই বন্ধ রাখতে হতো। ঈদে মুক্তির পর থেকেই দর্শকদের কাউন্টার বা অনলাইন থেকে কয়েকদিন পরে দেখার জন্য টিকেট কিনতে হচেছ।
একসাথে একাধিক বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে এমন আগ্রহ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখা যায়নি। এ তিনটি সিনেমাকে ঘিরে যা হলো – তাতে সিনেমার ভালো সময়ের লক্ষণ পরিষ্কার, কিন্তু সেটি টেকসই করার জন্য দরকার নিয়মিত ভালো সিনেমা আর দেশজুড়ে মানসম্মত সিনেমা হল। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে মাঝেমধ্যেই হঠাৎ এমন কিছু সিনেমা আসছে, যা দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিন্তু এরকম ছবির মুক্তি পাওয়াটা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে না বলে কিছুদিন পরেই সিনেপ্লেক্সগুলোতে দেখানো ইংরেজি বা হিন্দি সিনেমাগুলোতে আবার আলোচনায় চলে আসে। এবার যে ছবিগুলো এসেছে এগুলো এফডিসি ঘরানার বাইরের সিনেমা। কিন্তু এগুলো প্রমাণ করেছে যে মোটামুটি দেখার মতো সিনেমা হলেই মানুষ হলে আসবে। কারণ বিনোদনের আর কোন মাধ্যম এদেশে নেই।
দেশে এখন সিনেমা হলের সংখ্যাই হাতে গোনা এবং সেগুলোর আবার পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে এ তিনটি সিনেমা একটি আশাব্যঞ্জক পরিবেশ তৈরি করেছে বাংলা সিনেমার জন্য। মানুষ যে মুখিয়ে আছে ভালো বাংলা সিনেমার জন্য সেটিই আবার প্রমাণ হলো। কিন্তু সব স্তরের মানুষকে আবার হলমুখো করতে আরো অনেককিছু করতে হবে।বাংলাদেশের এর আগে আয়নাবাজি, দেবী, ঢাকা অ্যাটাক, মনপুরা কিংবা স্বপ্নজালের মতো কিছু সিনেমা গত কয়েক বছরে বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলো। তবে এগুলো আলাদা আলাদা সময়ে মুক্তি পেয়েছিলো এবং এর পরের অন্য সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রে দর্শকদের ততটা আগ্রহ দেখা যায়নি। এসব সিনেমার প্রযোজক-পরিচালকরাও নিয়মিত নতুন সিনেমা নিয়ে আসেননি। ভালো সিনেমা পেলে মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখে- এটি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করবে নতুন বিনিয়োগের জন্য। তবে সিনেমার গল্প, নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি প্রমোশন বা মার্কেটিং যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ- সেটিও এ তিনটি ছবি প্রমাণ করেছে। এবার হাওয়া সিনেমার প্রমোশন হয়েছে অসাধারণ। এ তিনটি ছবি মানুষ এমন সময় দেখছে যখন মানুষ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি বা তেমন আশঙ্কার মধ্যে আছে। এটা প্রমাণ করেছে বিনোদনের জন্য সিনেমা এখনো কতটা শক্তিশালী। ঠিকভাবে সততার সঙ্গে সিনেমা তৈরি হলে ও এর প্রচার ঠিকমতো হলে মানুষ আবার হলে ফিরে আসবে। বড় পর্দার বিনোদন অনেক দিন ধরেই মানুষ পাচ্ছিল না।
এখন এ তিনটি সিনেমার সাফল্য লগ্নিকারকদের মধ্যেও আগ্রহ তৈরি করবে। বিনিয়োগের সাহস বাড়বে। নির্মাণের সাহস বাড়বে। এতদিন প্রযোজক ও ডিস্ট্রিবিউটররা লাভ পেতোনা বলে বিনিয়োগ করতেননা। এখন সেটি হয়তো পাল্টাবে। আবার পরাণ ও হাওয়া কিন্তু নতুনদের নিয়ে তৈরি করা। ফলে নতুন শিল্পী ও গল্পেও বিনিয়োগ আসবে। বাংলাদেশি সিনেমাকে আবার জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে অনেক বাধা আছে, যেগুলো দুর না করলে মাঝেমধ্যে এমন কিছু ছবি ভালো করবে- কিন্তু দিনশেষে তা বাংলাদেশি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে দর্শককে আগের মতো করে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স ছাড়া দেশের সিনেমা দেখার মতো ভালো পরিবেশ আছে এমন সিনেমা হল নেই বললেই চলে। দেশজুড়ে এখন মাত্র ৫০/৬০টি প্রচলিত ধারার সিনেমা হল এখন চলমান আছে। আর সব হল ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে দর্শক শূন্যতা ও অশ্লীলতার কারণে। মাঝে এমন পরিবেশ হয়েছিলো যে হলের সামনে দিয়ে যেতেও অস্বস্তি হতো। আর এখন তো বন্ধই হয়ে গেছে হলগুলো। সরকার প্রতি উপজেলায় সিনেপ্লেক্স তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি হলে আর বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসলে বাংলাদেশি সিনেমা আবার যে দর্শক পাবে এবারের আলোচিত তিনটি সিনেমাই তার প্রমাণ