দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে, যার ফলে সাধারণ জনগণের আয়-ব্যয় সামঞ্জস্য করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ছে, কারণ তাদের আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনও মিল থাকছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনেক মানুষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, সবজি, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের আমিষ ও পুষ্টি পূরণএখন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজারের আগুন যদি এইভাবে জ্বলতেই থাকে তবে অনাহারে, অর্ধাহারে,পুষ্টিহীনতায় আমরাই হয়তো একদিন নিভে যাব।এই তো সেদিন বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি চায়ের দোকানে ঢুকলাম। চায়ের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আশপাশের টেবিলগুলোয় দেখি সবাই যে যার মতো কথা বলছে। পাশের টেবিলে একজন আরেকজনকে বলছে, ‘ভাইরে আর বাঁচব না! বাঁচার রাস্তাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।’ দিন দিন শ্রেণিবৈষম্য প্রকট হচ্ছে। বাড়ছে নৈরাজ্য, ঘুস-দুর্নীতি-লুটপাট, আয়বৈষম্য। আর তাই একশ্রেণির মানুষ দিন দিন আঙুল ফুলে বটগাছ হচ্ছে। রাতের আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের সচল গতিশীল অর্থনীতি। সিন্ডিকেট জনজীবনে দুর্ভোগ এবং পারিবারিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করে। কোনো সভ্য দেশে এমন সিন্ডিকেট থাকতে পারে না। গোটা দেশ, দেশের ১৮ কোটি মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে এই সিন্ডিকেট বা কারসাজিকারীদের কাছে।
যে কোনো পরিস্থিতিতে যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে তাদের সুযোগসন্ধানী বলে। সুযোগ পেলেই তাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতাকে দক্ষতা বলা হয়। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তাকে সুযোগে রূপান্তরিত করতে পারেন যারা তারা হলেন ব্যবসায়ী। মানুষের হাত দুটো হলেও আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের হাত মূলত তিনটি ডান হাত, বাম হাত এবং তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি হাত হলো অজুহাত। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে সবচেয়ে বেশি মজুদ থাকে তা হলো অজুহাত। যে কোনো অজুহাতেই তারা দ্রব্যমূল্য বাড়াতে পারেন। বন্যা, খরা, শীত, দেশ থেকে বহুদূরে যুদ্ধ লাগলে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে কিংবা ঈদ, পূজা, নববর্ষ সব কিছুকেই তারা অজুহাত বানিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিতে পারেন। মানুষের আবেগ, উৎসব বা উৎকণ্ঠা সবই যেন মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সব স্তরের মানুষের ভোগান্তি বাড়ে কিন্তু সীমিত আয়ের মানুষের জন্য তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং পণ্যের কৃত্রিম সংকটের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনমানের অবনতি ঘটেছে। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মানুষ নাজেহাল হচ্ছে। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা শুধু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেই ক্ষান্ত নয় তার সাথে আছে ভেজালের সমারোহ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে দিনে কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি ডিমের চাহিদা আছে দেশে। তাহলে শুধু ডিমের জন্য প্রতিদিন বাড়তি টাকা লাগে প্রায় ১৩ কোটি। যদি প্রতি দিন গড়ে ৬কোটি কেজি চালের দরকার হয় এবং গড়ে যদি কেজিপ্রতি ৫টাকা করে বাড়িতি ব্যবসা করা হয় তবে চালের বাজার থেকে দৈনিক জনগণের পকেট থেকে দৈনিক ৩০কোটি টাকা এবং আরো অন্যান্য পন্য থেকে বের করে নেওয়া এই টাকা কে পায়, কোথায় যায়? বাজার নিয়ন্ত্রণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দ্বিধা করছে না ক্রেতারা। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে পণ্যের দাম। বাজারের এই আগুন শুধু খাদ্যদ্রব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এই আগুর অস্বাভাবিকভাবেও ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষা সামগ্রী, জীবন রক্ষা ওষুধসহ অন্যান্য পণ্যেও।বিক্রেতাদের অজুহাত, বন্যার কারণে সরবরাহে ঘাটতি তাই দাম বেড়েছে সবজির। কিন্তু ক্রেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। আগে বলা হয়েছিল, উত্তরবঙ্গ থেকে আসা ট্রাকে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে ঢাকায় সবজির দাম বেশি। পুরনো চাঁদাবাজরা তো পালিয়েছে তাহলে এখন প্রশ্ন উঠছে, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি নাকি সরকার ব্যবস্থা নিতে পারছে না? দেশের পটপরিবর্তন হলেও বাজার সিন্ডিকেট কি একই থেকে গেছে? দায় এড়ানো যতই চলুক, বাস্তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের।
কেন সাধারণ মানুষ আশা করে স্ফীত মূল্য কমে যাক? কারণ মূল্যস্ফীতি তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে দেয় যার প্রভাব পড়ে পেট থেকে মাথায়। দৈনন্দিন খাবারে টান পড়ে আর জীবন যাপনের ব্যয় নির্বাহ করতে দুশ্চিন্তা ও ঋণের বোঝা বাড়ে। এর জন্য যে যে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকার সেই সব ব্যবস্থা নিক।সাধারণ জনগণের দিকে তাকিয়ে মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।আবার কাঁচামালের মূল্য কিছুটা হ্রাস পেলেও পণ্যের মূল্য কেন কমে না। তার কারণ ও কারসাজি কী, সেটাও উদঘাটন হওয়া দরকার। দুর্নীতি, দুঃশাসনের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল বলেই মানুষ আন্দোলনে নেমেছিল। সরকার পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করেছে কিন্তু সিন্ডিকেট কি লোভ ত্যাগ করেছে? প্রতিদিন পত্রিকায় আসছে গত সরকারের আমলে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটগুলো কী পরিমাণ টাকা লুটপাট ও পাচার করেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফার জন্য পুঁজিপতিরা সব করতে পারে। উপদেশ দিয়ে লোভ ও লুণ্ঠন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। জনগণকে সান্ত্বনা দিয়েও তাদের আর্তনাদ থামানো যাবে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। গণ-অভ্যুত্থানের পর শ্রীলঙ্কা দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরুক সরকার। এমন প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের পথটাও নির্ধারণ করা দরকার।সাধারণ মানুষ বেশি কিছু চায় না। চায় শুধু মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের নিশ্চয়তা। বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ, অসাধু ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টিসিবিকে আরও শক্তিশালী ও সক্রিয় করার পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষকে আরও কার্যকর করে তুলতে হবে। বাজার সিন্ডিকেট ভাংতে না পারলে অপরাধ প্রবণতা এবং টাকা পাচার রোধ করা সম্ভব নয়। সম্ভব হবে না দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রেখে সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। আমরা সিন্ডিকেটমুক্ত দেশ চাই। ক্রয়ক্ষমতার নিশ্চয়তা চাই। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা চাই।