বছরের শুরু থেকেই অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, তেল ও পেঁয়াজের মতো ভোগ্যপণ্যের দাম। এর মধ্যেই বাজারে সক্রিয় সিন্ডিকেট। ঠুনকো অজুহাতে কারসাজি করে তারা দফায় দফায় বাড়াচ্ছে জিনিসপত্রের দাম। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকারও। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, এখন থেকে আটটি নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেবে সরকার। নির্ধারিত দামের চেয়ে কেউ বেশি নিলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলেও জানান তিনি।
সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ায় সাধুবাদ জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বর্তমানে আলু, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। এমনিতেই করোনায় অনেকের আয় কমে গেছে, কেউ বেকার হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নেমে এসেছে বাজারে মুনাফার ছোবল। এতে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের লোকজন চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
সরকারের কঠোর পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়ানো ও ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে সরকার কঠোর পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে তা দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেন তিনি। পাশাপাশি আমদানিনির্ভর সব নিত্যপণ্যের মজুদ নজরদারির আওতায় এনে সরকারিভাবে মজুদ বাড়ানোর সুপারিশও করেন গোলাম রহমান।
আরো কিছু পদক্ষেপের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নিয়মিতভাবে বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মজুতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সেসঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটবাজদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পণ্য সংকটের অজুহাতে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা যেন পণ্যের দাম বাড়াতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
নিত্যপণ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ করে পণ্যের সরবরাহ, মজুত ও আমদানি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এক জরুরি সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এসব সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত জরুরি সভাটি গতকাল মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বাণিজ্য সচিব, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান, ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতিও উপস্থিত ছিলেন।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটিসহ ওষুধপত্র প্রভৃতির দাম। শুধু তাই নয়, ডিমের দামও আগের তুলনায় কয়েক গুণ বাড়িয়ে নেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। যদিও সরকারের কঠোর তদারকিতে তা আবার কিছুটা নেমেছে, তবে স্বাভাবিক হয়নি এখনো। ফলে প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েন।
সরকারি হিসাবেই মোটা চালের কেজি এখন ৫৮ টাকা হয়েছে। বাজারে যা কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৬০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমান বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়- খোলা সয়াবিন তেল ১৮৫ টাকা, পাম অয়েল ১৪৫, দেশি পেঁয়াজ ৫০, আমদানি করা পেঁয়াজ ৪৫, ব্রয়লার মুরগি ১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের হালি ৪২ টাকা এবং প্রতি আঁটি শাকসবজি ১০-১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
জানা গেছে, কারসাজি করে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র রয়েছে ঢাকার মৌলভীবাজার, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দরে। এছাড়া ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক পর্যায়েও বড় ধরনের কারসাজির কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ুন কবীর বলেন, ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন অজুহাতে বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ান। তাই কঠোর মনিটরিং করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, ঠিকমতো বাজার মনিটরিং না করলে সুবিধাবাদী একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়। তাই গভীরভাবে বাজার পর্যালোচনা করা উচিত সরকারের।
এদিকে টিসিবির মাধ্যমে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, চিনি বিক্রি চলছে। ইতোমধ্যে বিশেষ কার্ডের মাধ্যমে দেশের এক কোটি পরিবারকে এই সহায়তা দেয়া হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ভোজ্যতেল, ডাল, চিনি ও পেঁয়াজের সঙ্গে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডে ১০ কেজি চাল দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের ২ হাজার ৩৬৩টি কেন্দ্রের ওএমএস ডিলারদের মাধ্যমে মাসে একবার এ চাল নেয়া যাবে। কাল ১ সেপ্টেম্বর থেকে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি কার্যক্রমও চলবে। চাল ও জ্বালানি তেলের ওপর থেকে অগ্রিম কর ও আমদানি শুল্ক কমানোর আদেশ সংবলিত প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, টিসিবি কার্ডধারীরা ওএমএসের মতো ১০ কেজি করে চাল পাবেন।
কার্ডধারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাল দেয়া হবে। পাশাপাশি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ের ৫০ লাখ ১০ হাজার ৫০৯টি প্রান্তিক পরিবারকে প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে মাসে ৩০ কেজি চাল দেয়া হবে। টিসিবি জানিয়েছে, স্থানীয় ডিলারের কাছ থেকে একজন ক্রেতা প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১১০ টাকা দরে দুই লিটার করে কিনতে পারছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬৫ টাকা করে দুই কেজি, চিনি ৫৫ টাকা দরে দুই কেজি ও প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২০ টাকা দরে পাঁচ কেজি কিনতে পারছেন। চাল বিক্রি শুরু হলে ১০ কেজি কিনতে পারবেন। এছাড়া ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক দর অনুসরণ করে জ্বালানি তেলের দাম নতুন করে সমন্বয় করে লিটারে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৭ থেকে ঢাকার বাজার তদারকির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ২৮টি মনিটরিং টিম রয়েছে। একজন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, অর্থ, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন করে কর্মকর্তা এবং আনসার, পুলিশ ও র্যাবের সমন্বয়ে গঠিত এসব টিম সারা বছর মাঠে থাকার কথা থাকলেও মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণে তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। এসব টিম নিয়মিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টিম ছাড়াও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি করপোরেশন, র্যাব এবং জেলা প্রশাসনের একাধিক টিম বাজার মনিটরিংয়ে কাজ করে। যেকোনো পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে উৎপাদনসহ পাইকারি ও খুচরা মূল্য মনিটরিং করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।