বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সব দেশেই কোনো না কোনোভাবে সরকার গঠিত হয়ে থাকে এবং সে সরকারই তার দেশ পরিচালন করে থাকে। সব দেশের সরকার চায় সফলতার সার্টিফিকেট। দেশ সুন্দর এবং সফলভাবে পরিচালনে দরকার সুন্দর কার্যকর পরিকল্পনা। পরিকল্পনা দীর্ঘ এবং স্বল্পমেয়াদী হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় থাকে প্রধানত নীতিমালা। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম হলো একটি বার্ষিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, যাকে বাজেট বলা হয়। এই বাজেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সরকারের রাজস্ব আহরণ এবং খরচ, যা ইংরেজিতে বলা হয় ফাইন্যান্স আইন। বাজেটের প্রভাবে সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রভাবিত হয়। দেশের সব দ্রব্য, সেবার বিনিময় বা বিক্রয়মূল্যের পরিবর্তন আসে করের কম বা বেশি হার ধার্য করায়। এবং এই কারণেই বাজেট নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই চিন্তা করে, যেহেতু এর প্রভাবে সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রভাবে সমাজের সবাই যেহেতু জড়িত হয়ে যান বা যেতে হয়, তাই অনেকেই কমবেশি খবর রাখেন, চিন্তা করেন, মন্তব্য করেন বা করতে হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে আলোচনা-সমালোচনার বেশ প্রয়োজনও রয়েছে। আলোচনা-সমালোচনার পর যে বাজেট মহান সংসদে পাশ হয়, তখন অনেক কিছুর পরিবর্তন করতে হয় বা হয় সমাজের মঙ্গলের জন্য। এবং এ কারণেই যে সমাজের মানুষ যত বেশি খবর রাখবে, চিন্তা করবে, সে সমাজ তত সজাগ এবং তত ঊর্ধ্বমুখী।
বাজেটের প্রধান আলোচনার বিষয় দ্রব্যমূল্য, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে আলোচনায় চলে আসে কোন কোন দ্রব্যের দাম বাড়বে এবং কেন কোন দ্রব্যের দাম কমবে। আয়কর নিয়েও মানুষের চিন্তা থাকে। সাধারণ মানুষ সব সময় আশা করে, তাদের নিত্যপণ্যের দাম কমবে বা আগের মতোই থাকবে। প্রধান আলোচ্য বিষয়ই থাকে মূল্যস্ফীতি নিয়ে। বাস্তবতা সব সময় ভিন্ন। সরকার থাকে রাজস্ব আহরণের চিন্তায়। রাজস্ব আহরণে প্রচলিত যে পন্থা রয়েছে, তা হলো ‘প্রত্যক্ষ’ ও ‘পরোক্ষ কর’ ব্যবস্থা। অর্থনীতির ভাষায় দেশে প্রত্যক্ষ কর আহরণের পন্থা বেশি সহায়ক। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাজস্ব আহরণে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। পরোক্ষ করের প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর। দেশের উন্নয়নে সরকার রাজস্ব আহরণ করবে এবং জনগণকেও সেই কাজে সহযোগিতা করতে হবে। এখানেই দেশপ্রেমের পরীক্ষা। স্বাভাবিক নিয়মে সরকার যেমন আহরিত কর জনগণের মঙ্গলে ব্যয় করবে তেমনি জনগণও সরকারের রাজস্ব আহরণে সহায়তা করবে। এমন অবস্থা যে দেশে বিরাজমান, সে দেশেই হয় উন্নয়ন। উন্নয়ন অর্থ দেশের জনগণের আয়-উপার্জন বাড়বে, সঞ্চয় বাড়বে, এককথায় জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে, গড় আয়ও বৃদ্ধি পাবে। এক কথায় আয়বৈষম্য সহনশীল পর্যায়ে থাকবে। তুলনামূলকভাবে দারিদ্র্যের হার আশাপ্রদ পর্যায়ে পৌঁছবে এবং সংখ্যাও হ্রাস পাবে।
উন্নয়নশীল অর্থনীতির প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মুদ্রাস্ফীতি। আমার মতে তারা যমজ দুই ভাই। তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা আসলেই কঠিন। কারণ সে খুব সহজেই শত্রুকে বন্ধু বানাতে পারে। এই বুদ্ধিমানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রয়েছে জনগণের পক্ষে কাজ করার জন্য সরকারের অনেক জনবল। তার পরও সাধারণ জনগণ মাঝেমধ্যে অসহায় হয়ে পড়ে। প্রতিটি দেশের সরকারের দেশ শাসনের জন্য থাকে নীতি ও নীতিমালা। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমের কিছু নেই। ব্যবসায়ীরা দেশের আইনকানুন মেনে ব্যবসা করবেন বা করেন। আমি বিশ্বাস করি, একটি দেশের অধিকাংশ মানুষ সহজ সরল, আইন মেনে চলেন। সুযোগসন্ধানীর সংখ্যা সব সময় বেশি থাকে না। তবে সমাজে অনিয়ম, দুর্নীতি বেশি হলে সুযোগসন্ধানীরা বুক ফুলিয়ে চলেন, তখন সমস্যা বাড়তে থাকে। সরকার যদি সততার সঙ্গে দেশ শাসন করতে চায়, তাহলে দ্রব্যমূল্য সহনশীল থাকার কথা। অর্থনীতির ভাষায় দ্রব্যমূল্য বাড়ার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে যদি অসাধু ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় রাখতে পারেন, তাহলে হঠাৎ হঠাৎ আমাদের পণ্য যে অস্বাভাবিক দামে নিত্য কিনতে হয়, তা হওয়ার কথা নয়। সমাজে সুশাসন থাকলে সব ঘটনার কারণ খুঁজে পাওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব। সরকারের পক্ষে বাজেটের প্রধান কারণই সুশাসন নিশ্চিত করা।
বাস্তবমুখী বাজেট পরিকল্পনা এবং সফল বাস্তবায়নে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থবছর এক প্রতিযোগিতাময় পরিস্থিতির সম্মুখীন বিভিন্ন কারণে। সবকিছু বিবেচনায় বাজেটে দেশের একদল উল্লেখযোগ্য মানুষ, যাদের দৈনিক আয় ২ দশমিক ১৫ মার্কিন ডলারের নিচে আয়, তাদের স্বার্থ দেখা এবং দেশীয় পণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া। বাজেটের পরোক্ষ করের প্রভাব শুরু হয়ে যায়, মহান সংসদে বাজেট উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে আর প্রত্যক্ষ করের প্রভাব শুরু হয় বাজেট পাশের পরপর। আমাদের বর্তমান বাজেটে কলম, বাইসাইলের ওপর ভ্যাট প্রয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। আমাদের সরকার শিক্ষা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের চিন্তা করছেন এবং সে রকম কাজ না করলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বা সময় বেশি লাগবে। যেহেতু পরোক্ষ কর প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগ হয়, সে কারণেই আমি বলব, পরিকল্পনার সময় চিন্তা করা উচিত। সরকার ৫ লাখ কোটি টাকা আয়ের জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে, তা আমাদের বর্তমান কর আহরণের হার এবং পরিমাণ বিবেচনায় আমার মনে হয় কঠিন হবে এবং বাস্তবায়নে কৌশলী হতে হবে, তবে ১৮ কোটি মানুষের দেশে তা আরও আগেই সম্ভব ছিল। তবে এমন কৌশল গ্রহণ করা উচিত নয়। যেমন, উড়োজাহাজ ইজারায়, রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজারে ভ্যাট ছাড়। বিষয়টি আমাদের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য সহায়ক নয়। অনেকদিন পর ব্যক্তিশ্রেণিতে করমুক্ত আয়সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার করার পদক্ষেপ মন্দের ভালো; কিন্তু একই সঙ্গে চাকরিজীবীর ভাতা খাতের সব আয় করযোগ্য করার প্রস্তাবও করা হয়েছে। আমার মনে হয়, সরকার এই বিষয়ে বিবেচনা করবেন। তবে আমার মন বলছে, সরকার প্রত্যক্ষ কর আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর পথে আছেন, অবশ্য পরিকল্পনায় আছে বহুদিন যাবত না হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অফিসে ‘উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ আমদানিনির্ভর বিধায় পরোক্ষ করের সংগ্রহ বেশি, যা উন্নত সমাজ বিনির্মাণের অন্তরায়’ এমন সুন্দর কথা শোভা পেত না।
২০২৩ সালে কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশের বয়স ৫২ বছর। সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাংলাদেশে এখন প্রায় ১৮ কোটি মানুষ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণার মূলমন্ত্র অনুযায়ী বর্তমানে সবার অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মাত্রায় সুখী থাকার কথা। এ পর্যন্ত সব সরকার দেশ শাসন করে উন্নয়নের দাবি করেন, তাদের দাবির পক্ষে কিছু না কিছু যুক্তি অবশ্যই আছে। তবে দেশের এক উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ এখনো তাদের উপার্জিত আয় দ্বারা তাদের দৈনন্দিন খরচ মিটাতে পারেন না। তাদের সংখ্যা ১৯৭১ সালের সাড়ে ৭ কোটির মানুষের তুলনায় অর্ধেকের বেশি, সংখ্যার হিসাবে। অবশ্য শতকরা হিসাবে সরকার অনেক সফলতার দাবি করেন। বাংলাদেশের মানুষের দৈনিক আয় ২ দশমিক ১৫ মার্কিন ডলারের নিচে—এমন মানুষের সংখ্যা ২০২২ সালে ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যদি বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটিও ধরা হয়, তাহলেও প্রায় ২ কোটি মানুষের দৈনিক আয় ২০০ টাকার মতো। স্বাধীনতাসংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশে ২ কোটি মানুষ ঠিকমতো খেতে পারে না, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। এমন বাস্তবতায় আমাদের বাজেটে আয়বৈষম্য হ্রাসের ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিতে হবে। আয়বৈষম্য হ্রাসের সহায়ক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাত। এই খাতসমূহের বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অপচয় রোধ করতে হবে।