শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ চেয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। গ্যাসের দাম যৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে হলেও তা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে অবৈধ সংযোগ ব্যবহারকারীদের ব্যাপারে কঠোর হতে তারা সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সরকারের প্রধান লক্ষ্য সব গ্রাহকের কাছে গ্যাস সরবরাহ করা। এমনকি বাড়তি দামে হলেও সবার জন্য গ্যাসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাসের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলের বাইরে নতুন কারখানা নির্মাণ না করতে তিনি ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেন।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) মিলনায়তনে এক অংশীজন সংলাপে এমন বক্তব্য আসে। ‘জ্বালানি কৌশল :অনুমানযোগ্য ভবিষ্যতের প্রতি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ডিসিসিআই। অনুষ্ঠান শেষে প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আসন্ন বাজেটের আগে জ্বালানির দাম বাড়বে না।
অনুষ্ঠানে মূল আলোচ্য বিষয়ে তথ্য বিশ্লেষণসহ সরকারের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করেন নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকার গ্যাসের দাম নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। প্রতি তিন মাস পরপর এই মূল্যহার নির্ধারণ করা হতে পারে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, অধিকাংশ শিল্পকারখানা গ্যাসের একটি বৈধ সংযোগ নিয়ে রেখেছে। সেটির পাশাপাশি আরেকটি সংযোগ অবৈধভাবে নিয়ে রেখেছে। এর ফলে বৈধ সংযোগ নেওয়া অন্য শিল্প গ্রাহকেরা বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারও বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার এখন কঠোর অবস্থান নিয়েছে। অবৈধ এসব সংযোগ খুঁজে দিতে অন্য শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা কামনা করে নির্ধারিত সময়ে গ্যাসের বিল পরিশোধের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং শিল্পে গ্যাসের অপরিকল্পিত সংযোগের কারণেও অনেক অপচয় হচ্ছে। অনেকে গ্রামে দূরবর্তী এলাকায় জমি কিনে বা পেয়ে শিল্পকারখানা করেছেন, যা গ্রিড থেকে অনেক দূরে। সেগুলোতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দিতে গিয়ে জ্বালানির অপচয় হচ্ছে। আবার তারাও ঠিকমতো গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছেন না। তাই ভবিষ্যতে এটি চলতে দেওয়া হবে না। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিদ্যমান শিল্পাঞ্চলে কারখানা গড়তে হবে। এর ফলে গ্যাসের অপচয় রোধের পাশাপাশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। সরকার ও ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যমান ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পের ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র/জেনারেটর) জ্বালানি দক্ষতা প্রায় ৪০ শতাংশ কম। অথচ ক্যাপটিভে মোট গ্যাসের ১৭ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো ধাপে ধাপে কমিয়ে আনতে হবে। এই গ্যাসের দক্ষ ব্যবহার শিল্পে সরাসরি সরবরাহ বাড়াতে সাহায্য করবে। শিল্পকারখানাগুলোতে এনার্জি এফিশিয়েন্সি (জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার) নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য শিল্পগুলো সাসটেইনেবল রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (স্রেডা) সহায়তায় বিনা মূল্যে তাদের কারখানার এনার্জি অডিট করাতে পারে। তিনি বলেন, জ্বালানির দাম বাড়বে। তাই এর দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবহার করতে হবে।
নসরুল হামিদ বলেন, গার্মেন্টসে গ্যাসে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তার সুফল পাচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা। তাই গ্যাসের দাম কম না দিয়ে ঐ ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিতে হবে, যেমনটি প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের কোম্পানিগুলো করে থাকে।
তিনি আরো বলেন, ‘অনেকে বলেন আমরা গ্যাসের ওপরে ভাসছি। আসলে এটা সত্য নয়। যদি কাতারের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে আমরা কোথায়? আমাদের নানান জায়গায় গ্যাস পাওয়া গেলেও তা ওঠানো সম্ভব হয় না। এ কারণে পরিমাণেও কমতে থাকে। একটা গ্যাসের কূপ খনন করতে ৯-২১ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এরপর আপনি সেখানে গ্যাস না-ও পেতে পারেন। ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা পূরণে ভোলা থেকে গ্যাস আনার চেষ্টা করছি।’
এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এমপি বলেন, সরকারের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে এখনো গ্যাস-বিদ্যুৎ, পরিবহনসহ অন্যান্য সেবা শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। এগুলো সম্পন্ন হতে আরো পাঁচ বছর লাগবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে সব সেবা নিশ্চিত করা গেলে উদ্যোক্তারা শিল্পাঞ্চলে কলকারখানা স্থাপনে উত্সাহিত হবেন। তিনি বলেন, যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস-বিদ্যুতে অবৈধ সংযোগ রয়েছে, তা বিচ্ছিন্নকরণে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। এটা বন্ধ করা না গেলে সত্যিকারের উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ডিসিসিআইয়ের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার বলেন, দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নে একটি পূর্ব অনুমানযোগ্য জ্বালানির মূল্য নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে জ্বালানির চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা আবার সংশোধন করা দরকার।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী বলেন, জ্বালানির দামের বিষয়ে আরো স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। জ্বালানির অনুমানযোগ্য মূল্যের বিষয়ে একটি দীর্ঘময়োদি পরিকল্পনা থাকা অপরিহার্য।
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম, আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন, ফিকির সভাপতি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সিইও নাসের এজাজ বিজয়, ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও ড্যাফোডিল গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান, সামিট পাওয়ারের পরিচালক ফয়সাল করিম, এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বারভিডার সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ ডন।