দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কুড়িগ্রামে আকস্মিক ও ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যার্ত মানুষের জন্য কাজ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। বানভাসি মানুষের জন্য যারা কাজ করছে তাদের ভেতর আলেমসমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সংকটের প্রথম দিন থেকে তাঁরা মাঠে থেকে কাজ করছেন।আলেমদের পরিচালিত ও নেতৃত্বাধীন কিছু সংগঠন ও সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা তুলে ধরা হলো—
আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন : এবারের আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে এক হাজার মেট্রিক টন ত্রাণসামগ্রী বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। এরই মধ্যে তারা সাত শ মেট্রিক টন জরুরি ত্রাণসামগ্রী কেনার কাজ শেষ করেছে, যা পর্যায়ক্রমে দুর্গত মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হবে। গত ২৩ জুন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমদুল্লাহ এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, তাঁরা ২০ হাজার বন্যার্ত পরিবারের জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম শামসুস সালেকিন, পিএসসি কমান্ড্যান্টের হাতে ১০০ টন ত্রাণ হস্তান্তর করেছেন এবং সুনামগঞ্জে প্রায় ১০০ টন ত্রাণ পৌঁছেছে। গতকাল (২৪ জুন) শায়খ আহমদুল্লাহ নিজে সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওর অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের ক্রয়কৃত ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে আছে চাল, ডাল, লবণ, সয়াবিন তেল, খেজুর, হলুদ-মরিচের প্যাকেট, চিড়া, শিশুখাদ্য, ছাতু, ওষুধ ইত্যাদি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ : প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা বিপর্যয়ে জনসেবা করে এরই মধ্যে সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সিলেট বিভাগে বন্যা শুরু হওয়ার একদম শুরু থেকে বানভাসি মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে তারা। মূল দলের কেন্দ্রীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে একযোগে কাজ করছে দলটির ছাত্র ও যুব সংগঠনসহ সব সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘দলের আমির ও নায়েবে আমিরের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় আমরা প্রথম দিন থেকে কাজ করছি। দলের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম গত ২১ জুন নিজে ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন। ’
তিনি আরো বলেন, ‘কাজের ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কেননা এসব অঞ্চলে সহজে ত্রাণ পৌঁছায় না। আমাদের সহায়তার মধ্যে শুকনা ও প্রস্তুত উভয় প্রকার খাবার আছে। ত্রাণসামগ্রী প্রক্রিয়াজাত করতে আমরা সিলেট শহরে দুটি এবং সুনামগঞ্জে একটি পয়েন্ট নির্ধারণ করেছি। বন্যার পানি যেসব এলাকায় নেমে গেছে সেখানে আমরা পুনর্বাসনে সহযোগিতা করছি। মানুষের ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ, বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা ইত্যাদি কাজে সাহায্য করছি। বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তাই আমরা একটি মেডিক্যাল টিমও গঠন করেছি, যারা বন্যাদুর্গত এলাকায় চিকিৎসাসেবা দেবে। ’ সিলেট সুনামগঞ্জের বাইরে নেত্রকোনা, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামেও ইসলামী আন্দোলন ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানান মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।
পিসব : বন্যাদুর্গত এলাকায় পিপলস্ ইমপ্রুভমেন্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ (পিসব) ১৯ মে ২০২২ থেকে ধারাবাহিক কাজ করে যাচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে এখন পর্যন্ত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সাত হাজার পাঁচ শ পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুই শতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মাছ ধরার বিভিন্ন ধরনের জাল, হাঁড়িপাতিল, টিন এবং দুই হাজার মানুষের মাঝে পুষ্টিকর প্রস্তুত খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, জামালপুর, কিশোরগঞ্জে এক হাজার ৫০০ পরিবারকে ১৬ কেজি করে খাদ্য ও ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। বন্যা-পরবর্তী স্যানিটেশন, টিউবওয়েল, গৃহ সংস্কার, নৌকা, জাল বিতরণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। ওই প্রকল্প পরিচালনা করছেন মাওলানা ইমরান হুসাইন হাবিবী ও তাঁর সঙ্গীরা।
খেলাফত মজলিস : সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের কাছে সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করছে খেলাফত মজলিস। বানভাসি মানুষকে সহযোগিতা করতে সিলেট জেলা ছাত্র মজলিসের পাঁচটি স্বেচ্ছাসেবক দল ও জেলা খেলাফত মজলিসের ১০টি স্বেচ্ছাসেবক দল একযোগে কাজ করছে। তাদের সহযোগিতার মধ্যে আছে শুকনা ও প্রস্তুত করা খাবার। সিলেট বিভাগের বাইরে কুড়িগ্রামেও একটি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দল কাজ করছে। দলের কেন্দ্রীয় সহপ্রচার সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুল হাফিজ খসরু জানান, খেলাফত মজলিস কেন্দ্রীয়ভাবে ফান্ড সংগ্রহ করলেও তাদের দলের সিলেট জেলা শাখার নিজস্ব বাজেট এক কোটি টাকা। বন্যার পানি নেমে গেলে তাদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হবে।
সিয়ানাহ ট্রাস্ট : একটি গবেষণাধর্মী ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন হলেও জনসেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে সিলেটের সিয়ানাহ ট্রাস্ট। সিলেট বিভাগে যখন প্রথম ধাপে বন্যা শুরু হয়, তখন থেকেই বন্যার্ত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলেন জানান ট্রাস্টের পরিচালক মুফতি জিয়াউর রহমান। তিনি জানান, প্রথম ধাপের বন্যায় খাদ্য বিতরণ ও পুনর্বাসনে জন্য ১০ লাখ টাকা বিতরণ করেছিল সিয়ানাহ ট্রাস্ট। দ্বিতীয় ধাপে বন্যা শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার খাদ্যসামগ্রী, প্রস্তুত ও শুকনা খাবার বিতরণ করেছে তারা। বন্যা-পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা আছে তাদের। পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য সিয়ানাহ ট্রাস্ট্রের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ লাখ টাকা।
সৃজন ঘর : সিলেটের তরুণ আলেমদের সংগঠন ‘সৃজন ঘর’ও বন্যার্ত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত তারা শতাধিক পরিবারকে নগদ অর্থ দান, কয়েক হাজার পরিবারের মধ্যে খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ করেছে। তরুণ এই আলেমরা শুধু নিজেরাই সহযোগিতা করছেন এমন না, বরং বানভাসি মানুষের জন্য কাজ করছে এমন একাধিক সংগঠন ও সংস্থার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সহযোগিতাও করছেন।
অন্যান্য সংগঠন : এ ছাড়া আলেমদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম, (পুরান ঢাকার) ইমাম পরিষদ, ইকরামুল মুসলিমিন ফাউন্ডেশন, সাবউ সানাবিল, বারাকাহ ইত্যাদি সংগঠন ও সংস্থা বানভাসি মানুষের জন্য কাজ করছে। সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরেও বহু আলেম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।