হঠাৎ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাড়ানো হয়েছে গণপরিবহনের ভাড়া। এ নিয়ে গতকাল বাসে বাসে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন কর্মীদের বাকবিতণ্ডা ও বচসা করতে দেখা গেছে। যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে অনেক পরিবহনে। গতকাল পর্যন্ত বাড়তি ভাড়ার তালিকাও লাগেনি নগর পরিবহনে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় বেশ কয়েকটি বাস জব্দ করে সংশ্লিষ্টদের জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি রুটে চলাচলকারী বাসে নেয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। টানানো হয়নি ভাড়ার তালিকা। সরকার মহানগরীতে প্রতি কিলোমিটারে বাস ও মিনিবাসে ভাড়া ৩৫ পয়সা বাড়ালেও বাস স্টাফরা ভাড়া আদায় করছেন কয়েকগুণ বেশি। বাসচালকরা কিলোমিটারের বিপরীতে স্টপেজ অনুযায়ী ভাড়া আদায় করছেন। প্রতিটি স্টপেজ ও দূরত্ব অনুযায়ী বাস ভাড়া বাড়িয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
তবে কিছু কিছু পরিবহনে পূর্বের ভাড়ার সঙ্গে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়তি নিতে দেখা গেছে। এদিকে গতকাল সপ্তাহের ১ম কর্মদিবস হওয়ায় সকাল থেকে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে মানুষের উপস্থিতি ছিল বেশি। বাসের সংখ্যা কম থাকায় রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে যাত্রীদের। প্রায় প্রতিটি বাসেই গাদাগাদি করে যাতায়াত করছেন তারা।
বাসের দরজায় ঝুলেও যাতায়াত করতে দেখা গেছে অনেককে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্টপেজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাসে উঠতে পারেননি নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। সাইনবোর্ড থেকে শ্রাবণ পরিবহনে গুলিস্তান আসেন সালেহউদ্দিন নামের এক কাপড় বিক্রেতা। বাসে বাড়ার তালিকা না থাকায় আগের অনুযায়ী ভাড়া দেন তিনি। এতে বাসের সহকারীর সঙ্গে বাধে বাকবিতণ্ডা। এক পর্যায়ে বাস থেকে নামিয়ে দেয়ার হুমকি দেয় চালক। পড়ে অন্য যাত্রীদের অনুরোধে ১০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে রক্ষা পান। সালেহউদ্দিন বলেন, গত বছর এই সময়ে ২০ টাকা দিয়ে সাইনবোর্ড থেকে গুলিস্তান আসতাম। পরে ডিসেম্বর মাসে ভাড়া ৫ টাকা বাড়িয়ে ২৫ টাকা করেছে। এখন নতুন করে আরও ১০ টাকা বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করেছে। সরকার কিলোমিটার অনুযায়ী ভাড়া বাড়ালেও তারা সেটা মানছেন না। বাস স্টাফরা নিজেদের মনগড়া ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষকে পরিবহন শ্রমিকরা জিম্মি করে নিচ্ছে। সরকারের উচিত এই ভাড়ার নৈরাজ্য বন্ধ করা। ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হয়েছে ৩০ টাকা। ২ দিন আগেই এই রুটে চলাচলকারী গণপরিবহনে ভাড়া ছিল ২০ টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দেড়গুণ বাড়া আদায় করেছে স্বাধীন, রমজানসহ বিভিন্ন পরিবহনগুলো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাজীপুর থেকে সদরঘাট রুটে প্রায় প্রতিটি বাসে ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেশি নেয়া হয়েছে। সায়েদাবাদ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত রুটে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি আদায় করা হচ্ছে। এসব রুটেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত টানানো হয়নি নতুন ভাড়ার তালিকা।
এদিকে গতকাল সকালে পরিবহন সংকটে পড়েন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী তুলি আক্তার। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল ৮টার দিকে কাজলা থেকে বাসে উঠি। বাস সংকটের খবর পেয়ে রোববার ৭টার দিকেই বের হই। ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাসে উঠি। রাস্তায় বাসের সংকট। যেগুলো চলাচল করেছে, সেগুলোও ছিল ভর্তি। ভেতরে মানুষ ঠাসাঠাসি করে যাতায়াত করছেন। আমি যে বাসে এসেছি সেটিতেও দাঁড়ানোর মতো অবস্থা ছিল না। অনেক কষ্ট করে চালকের পেছনে দাঁড়িয়ে আসলাম। আয়াত পরিবহনের এক শ্রমিক বলেন, রাস্তায় যাত্রী আছে অনেক। তেলের দাম বাড়ার কারণে বাসের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে মালিকরা। সরকার নতুন যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই অনুযায়ী ভাড়া আদায় করছি। তবে বাসের সংখ্যা কম থাকায় যাত্রীরা ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠছেন। এ জন্য অনেক যাত্রী বাড়তি ভাড়া দিতে চাচ্ছে না। আবুল হোসেন একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। প্রতিদিন গণপরিবহনে করে অফিসের কাজে বের হন। তিনি বলেন, ফার্মগেট থেকে প্রতিদিন গুলিস্তানে অফিস করতে যেতে হয়। টাকা বাঁচাতে গণপরিবহনে যাতায়াত করি। আজও ফার্মগেট থেকে মিরপুর রুটের বিহঙ্গ পরিবহনে উঠেছি। বাস ভাড়া প্রতিদিন ১০ টাকা দেই। কিন্তু আজ ১০ টাকা দিলেও ১৫ টাকা বাস ভাড়া চাচ্ছে। বাসের কন্ডাক্টর ১০ টাকা ভাড়া দিলে নিতে চাচ্ছে না।
বাসের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। আমরা সাধারণ মানুষ সবার কাছে জিম্মি। দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে সবকিছুতে আগুন। নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, সকালে মিরপুর-১ থেকে বাসে উঠেছি। যেখানে মোহাম্মদপুরের ভাড়া ছিল ১০ টাকা সেখানে ১৫ টাকা ভাড়া নিয়েছে। মানসিকভাবে দুশ্চিন্তায় আছি। আমি চাকরি করে আমার পরিবার চালাই। ঢাকা শহরে কীভাবে টিকে থাকবো ভাবছি। তেলের দামসহ সবকিছুতে রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছি। খরচের সঙ্গে কোনোভাবে জীবনের হিসাব মিলাতে পারছি না। সরকার যদি না বোঝে সাধারণ জনগণের কষ্ট। এভাবে সব কিছুর দাম বাড়তে থাকলে আমাদের জীবন চলবে কীভাবে। আয় তো এত হয় না। সংসারে খুব চাপ যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আর পারছি না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ওষুধ থেকে সব কিছুর দাম বেড়ে গেলে আমরা যাবো কোথায়? আগামী দিনগুলো কীভাবে কাটবে এটি নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে হচ্ছে। বোনকে নিয়ে ফুলবাড়িয়া বাস কাউন্টারে যাবেন সেলিনা আক্তার। তিনি কাওরান বাজার থেকে বাসে উঠেছেন। সেলিনা বলেন, এখানে ভাড়া দশ টাকা। আজ ১৫ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছে। আমি দুইজনের ভাড়া বিশ টাকা দেয়ায় কন্ডাক্টর তর্ক করা শুরু করে দিয়েছে। এরা যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া আদায় করছে। এরা শুধু ভাড়ার তালিকার কথা বলে কিন্তু কোনো গাড়িতে চার্ট ঠিকমতো দেখা যায় না। সরকারের নির্ধারিত ভাড়া কখনোই রাখে না। যা ভাড়া তার চেয়ে বেশি রাখে। আজমল হোসেন বলেন, ১০ টাকার ভাড়া ১৫ টাকা নিচ্ছে।
আগে যেখানে মিরপুর থেকে গুলিস্তান ৪০ টাকা করে যেতাম সেখানে ৫০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে। সুযোগ পেয়ে বাসের কন্ডাক্টর আমাদের কাছ থেকে ভাড়া বেশি নিচ্ছে। মেজবাহ বলেন, সকালে গুলিস্তান থেকে ৮ নম্বর বাসে করে কাওরান বাজার এসে নেমেছি। কাওরান বাজারে ব্যবসায়িক জিনিসপত্র কিনতে প্রায়ই আসতে হয়। দশ টাকা ভাড়া দিয়ে আসি। আজ সেখানে বেশি ভাড়া নিয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করেন জুবায়ের হোসেন। প্রতিদিন তাকে মিরপুর থেকে মোহাম্মদপুরে গণপরিবহনে আসতে হয়। তিনি বলেন, সকালে বাসা থেকে বের হয়েই রিকশা থেকে শুরু করে বাসে বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়েছে। এটি কি কোনো জীবন নাকি। শুধু যাতায়াতে এত খরচ হলে বাকি কাজ কীভাবে সামলাবো। রিকশায় ২০ টাকার ভাড়া ৫০-৬০ টাকা চেয়ে বসে থাকে। এদিকে আবার বাসের ভাড়া ২০ টাকার পরিবর্তে ৩০-৩৫ টাকা দিতে হয়েছে। কাজে বের হওয়ার সময় যদি ভাড়া নিয়ে বাসের লোকজনের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করতে হয় তাহলে সারা দিন কীভাবে চলবে। এদিকে বাজারে গেলে সবকিছুতে দামের আগুন।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহনের চালকের সহকারী কাওসার বলেন, আমাদের সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল ১০ টাকা। এখন ১৫ টাকা নিচ্ছি। নতুন নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা বের হয়নি। কাল তালিকা দিবে। গতকাল বাস নিয়ে রাস্তায় বের হইনি। আজ বের হয়েছি পেটের দায়ে। বাস নিয়ে বসে থাকলে তো আমার সংসার চালাতে পারবো না। এখন তেলের দাম বাড়ছে লিটার প্রতি ৪০ টাকা। এ জন্য ভাড়া বেশি নিচ্ছি। তেলের খরচ তো আমাদের বেশি চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সড়কে বাসের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে ঢাকায় পরিবহনের সংকট নেই। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করলে বিআরটিএ ব্যবস্থা নিবে।