২০২২ সাল জুড়ে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের হাত ধরে কিছু সময়ের জন্য হলেও বিশ্বের প্রধান শক্তি তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব। এর কারণও স্পষ্ট—আপেক্ষিক শক্তি ও দুর্বলতার স্থানান্তর। বৈশ্বিক অর্থনীতি শ্লথ হয়ে যাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মার্কিন মিত্র হিসেবে ইউরোপেও যে এর আঁচ লাগবে, তা চোখ বন্ধ করেও বলে দেওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে ঘটেছেও তাই। গোটা ইউরোপের অর্থনৈতিক চিত্র পালটে গেছে।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, যা অজানা নয় কারো। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মন্থর গতি থেকে নিস্তার পায়নি সাম্প্রতিক সময়ে আলো ছড়ানো গণচীনও। যদিও সমস্যার সম্মুখীন হলেও তা থেকে অবিস্মরণীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইতিবাচক পর্যায়ে আছে শি জিন পিংয়ের চীন। এরূপ প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের গভীর মৈত্রী এবং অর্থনৈতিকভাবে দেশটির ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয় কিছু রাষ্ট্রের কপালে। বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক প্রতিযোগিতা, শুল্ক ও বাণিজ্যযুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা ও ভর্তুকির মধ্য দিয়ে ২০২২ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক যুদ্ধ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। এসবের মধ্যে বিদায়ি বছর রেখে যাচ্ছে আরেক মহাসমস্যা—ইউক্রেন যুদ্ধ। যদিও আসল ঘটনা অন্যখানে। মূলত রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যে যুদ্ধ চলছে, তাকে ‘সামরিক যুদ্ধ’ বলা হচ্ছে যদিও, কিন্তু এর আড়ালে রয়েছে অন্য বাস্তবতা। এখন পর্যন্ত সংঘর্ষে উভয় পক্ষের সেনা এবং ইউক্রেনের জনগণের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগের বিষয়কে বাদ দিলে এই যুদ্ধকে ‘একটি সীমিত ও গৌণ ব্যাপার’ ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, এ বছরের মূল বাস্তবতা বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বনাম রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ। বলা বাহুল্য, উভয় পক্ষের নিষেধাজ্ঞা ও পালটা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে সমগ্র বিশ্বে চরম নাভিশ্বাস ওঠে, যার রেশ ক্রমশ বাড়ছেই। এর অভিঘাতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিসহ সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হয়ে বিশ্ববাজার হয়ে ওঠে টালমাটাল। দেশে দেশে বাজারব্যবস্থায় ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। পরিস্থিতি দিনে দিনে কেবল খারাপের দিকেই যাচ্ছে! উদ্বেগের সব থেকে বড় বিষয়, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি এতটাই বেড়েছে যে, বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৩ সাল থেকে চলছে ‘মহামন্দার বছর’।
উল্লেখ করা দরকার, বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতির গায়ে ক্রমাগতভাবে চাবুক মেরে চলেছে ঊর্ধ্বমুখী সম্পদ ও আয়ের পুনর্বণ্টন প্রক্রিয়া। এ দুটি খাতে ভারসাম্যহীনতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি। এর ফলে অনিবার্যভাবেই শ্রমগোষ্ঠী থেকে আসছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। ২০২২ সাল জুড়ে বিশ্বের বহু দেশে শ্রমিকশ্রেণির অসন্তোষ ছিল চোখে পড়ার মতো। সম্পদ ও আয় খাতে অস্থিরতার কারণে দৈনন্দিন ব্যয়সীমা সংকোচন করা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য একপ্রকার অসহনীয় হয়ে উঠেছে। শ্রমিকের রাস্তায় নেমে পড়া, সংঘবদ্ধ আন্দোলন, ধর্মঘট—এ সবই ছিল বছড় জুড়ে বড় সংবাদ। মজার ব্যাপার হলো, সমসাময়িক পুঁজিবাদ যে গভীরতর বৈষম্য, অস্থিতিশীলতা ও অন্যায়-অন্যায্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তা থেকে উত্তরণে তথাকথিত বাম ও ডান—উভয়পন্থি সরকার ও দলগুলো কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তা পর্যবেক্ষণে রাখে শ্রমিক সমাজ। এসব ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ না করায় শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তেই থাকে। এই অবস্থায় পুঁজিবাদের জাঁতাকলে পড়া ভুক্তভোগী নিম্নবিত্ত গোষ্ঠী হাত মেলায় পুঁজিবাদের সমালোচকদের সঙ্গে। এর ফলে মহাশক্তির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে উত্থান ঘটে গ্লোবাল সাউথের। এ অবস্থায় পুঁজিবাদী কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে কিছু পদক্ষেপ হাতে নেয় যদিও, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে তা যথেষ্ট নয় বলেই প্রতীয়মান হয়।
বর্তমানকালে বহু বিশ্লেষক দাবি করেন, ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। এমনিতেই বৈশ্বিক পুঁজিবাদ এই শতাব্দীতে ইতিমধ্যে তিন বার অত্যন্ত বাজেভাবে হোঁচট খেয়েছে—২০০০ সালে ডট কম সংকট, ২০০৮ সালে সাবপ্রাইম মর্টগেজ সংকট ও ২০২০ সালে কোভিড-১৯ সংকট। এই অবস্থায় নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরির প্রচেষ্টার ধাক্কা লাগবে বিশ্ব অর্থনীতির গায়ে—এটাই স্বাভাবিক। বাস্তব চিত্রও বলছে সে কথাই। উদীয়মান বিশ্বব্যবস্থা গঠনের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হওয়া ২০২২ সাল বিশ্বের জন্য রেখে যাচ্ছে নানা ‘অর্থনৈতিক বাস্তবতা’। বছরটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে এর অভিঘাত স্পষ্ট হতে শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ইস্যু ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ক্ষমতা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। এশিয়ায় যুদ্ধে হেরেছে মার্কিনিরা। অন্যদিকে সুদূর ১৯৪৫ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বৃহত্ অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন। এই অবস্থায় সামনের দিনে ঠিক কী ঘটতে চলেছে, তা নিশ্চিত করে বলা বেশ কঠিন।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আরো কিছু বিষয়ের ঘাত-প্রতিঘাতে মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বের পীঠে চড়ে বিশ্ব অর্থনীতির খেলোয়াড়দের নীতি ও কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে। লক্ষণীয় বিষয়, বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় খুব একটা ভালো ফলাফল করতে না পারার কারণে নব্য উদার বিশ্বায়নের নীতি থেকে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের পথ ধরেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বর্তমানে জো বাইডেনের শাসনকালের দিকে দৃষ্টি দিলে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে। এক কথায় বলতে গেলে, অর্থনীতির প্রশ্নে বিশ্বের দুই মেরুর দ্বন্দ্ব এখন অনেকটাই স্পষ্ট, যা বেশ প্রকট। রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন-ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল ও গ্যাসের মূল্যস্ফীতি এই দ্বন্দ্বকে আরো উসকে দিয়েছে, যা এখন এতটাই তীব্র যে, বিশ্ব অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারায়। বিশেষ করে অন্যান্য খেলোয়াড়ের তুলনায় চড়া মূল্য চোকাতে হচ্ছে ইউরোপকে।
আমরা দেখেছি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। রোজা লুক্সেমবার্গ, ইউজিন ডেবস ও ভ্লাদিমির লেনিনের মতো বাঘা সমাজতন্ত্রী নেতা পুঁজিবাদবিরোধী শ্রেণিসংগ্রামকে প্রাধান্য দিয়ে মাঠে নামেন। পুঁজিবাদ-উত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার রূপরেখা অঙ্কন করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রূপান্তরের গল্প শোনান। বিপরীতে, বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াইয়ে শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে কাজ করে যায় পুঁজিবাদী শক্তি। ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ জুড়ে দিয়ে মানুষকে যুক্তির বিচারে ফেলে দেন পুঁজিপতিরা। শেষ পর্যন্ত সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র বিভক্ত করে ফেলে পুরো বিশ্বকে। এই বিভক্তি স্থায়ী রূপ নেয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও দেখা যায় একই চিত্র। ইতিমধ্যে সামাজিক গণতন্ত্র ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্র—এ দুই গ্রুপে সমাজতন্ত্র বিভক্ত হয়ে পড়লেও দাপট কমে না এই ব্যবস্থার। বিশেষ করে প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে ও চীনে। বলা বাহুল্য, বিশ্ব ইতিহাসের দুটি নিকৃষ্টতম যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও চূড়ান্ত কারণের পেছনে বড় শক্তি হয়ে কাজ করে ‘পুঁজিবাদ’। ভয়ংকরতম এই যুদ্ধগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বহু চিন্তাভাবনার পর অনেকে এই আশায় সামনে এগোয় যে, লীগ অব নেশনস কিংবা জাতিসংঘকে সক্রিয় ও ক্ষমতায়িত করা গেলে বিশ্বের জন্য একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে। সত্যিকার অর্থে, যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হওয়া বৈশ্বিক ক্ষমতার রাজনীতি হটিয়ে তার জায়গায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই সংস্থাগুলোর প্রথম দিককার লক্ষ্য। পুঁজিবাদকে মৌলিকভাবে চ্যালেঞ্জ না করে বরং লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টাই ছিল সংস্থাগুলোর অগ্রাধিকার। এই উদ্দেশ্যে অর্থনীতির সংগঠনে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি মালিকানাধীন উদ্যোগকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তও করে সংস্থাগুলো। গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সংস্থাগুলো কালক্রম ব্যর্থ বলেই মনে করছেন বহু বিশ্লেষক। তবে এই হতাশার আড়ালেও বিশ্বের জন্য আছে আশার সংবাদ। বস্তুত, বিভিন্ন সংস্থার ব্যর্থতা আমাদের জন্য এমন পাঠ রেখে যাচ্ছে, যা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনগুলোতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। প্রথমত, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বেশি করে দরকার একটি ‘জুতসই ব্যবস্থা কিংবা বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার-পুনর্বিন্যাস’। একটি সত্যিকারের সমাজব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো ‘সিস্টেম’ বিশ্বের জাতিগুলো মেনেও নেবে, কারণ পরিস্থিতি দিনে দিনে জটিলতর হয়ে উঠছে। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটিয়ে স্থিতিশীলতাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকবে দেশ ও জাতিগোষ্ঠীর কাছে। সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের সম্পূর্ণ গ্যারান্টি প্রদান করা হবে—এমন গ্যারিন্টি দিতে পারবে যে অর্থনীতি, সেই ব্যবস্থাকেই স্বাগত জানাবে বিশ্ববাসী। শুধু রাজনৈতিক জীবনই নয়, অর্থনৈতিক জীবনকেও গণতন্ত্রীকরণ করা যায় কীভাবে—তাই থাকবে মূল অগ্রাধিকারে। মোট কথা, বিশ্ব অর্থনীতির স্বার্থেই হোক কিংবা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনের স্থিতিশীলতার প্রশ্নেই হোক, টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন নিয়ে ২০২৩ সালে পা রাখতে যাচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ।