বিচারক, বিচারব্যবস্থা কিংবা বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে কোনো কথা বলা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে বিবেচিত হওয়ায় অনেকেই এ বিষয়টি নিয়ে লিখতে চান না। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বিচারের রায় বা বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে অধিকাংশ মানুষের মনে অনেক অসন্তোষ দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে—যা বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। বিচারকও একজন মানুষ এবং তিনিও ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। তাই বিষয়গুলো খোলামেলা আলোচনা হলে সকলের জন্য মঙ্গল নয়। গত ২৬ এপ্রিল ২০২৩ টাঙ্গাইল আদালত চত্বরে প্রধান বিচারপতি বিচার প্রার্থীদের জন্য বিশ্রামাগারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে বলেন, ‘মামলার জট আমাদের চিন্তিত করেছে। আমরা এই জট নিরসনের চেষ্টা করছি। বিচারপ্রার্থীরা যদি দীর্ঘদিন আদালত চত্বরে ঘুরে বিচার না পান, তাহলে আদালতের প্রতি তাদের আস্থা হারাতে পারেন।’
প্রধান বিচারপতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ন্যায়সংগত কথা বলেছেন। মামলার রায়ের জন্য মানুষ বছরের পর বছর অপেক্ষা করেন। এই অপেক্ষার পালা শেষ হয় না। ন্যায়বিচারের অপেক্ষা করতে করতে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। মামলার জট খুলতে চায় না। মামলা মোকদ্দমার জন্য অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। অনেকে হয়রানির ভয়ে মামলা করতে চান না। একটা মামলা রুজু হলে তা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। শুনানির পর শুনানি, এ আদালত থেকে সে আদালতে ছুটতে ছুটতে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সহজে নিষ্পত্তি হয় না।
প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, ২০২২ সাল থেকে আমাদের বিচারকরা অবিরাম পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাদের অবিরাম পরিশ্রমের ফলে টাঙ্গাইল জেলার মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা ১০২ ভাগ। এটা খুবই আশার কথা। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো ২০২২ সাল থেকে মাননীয় বিচারপতিরা পরিশ্রম করছেন। এতদিন তারা অসংখ্য রুজুকৃত মামলা নিষ্পত্তির জন্য পরিশ্রম করেননি কেন? তারা যদি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য এত বছর পরিশ্রম করতেন, তাহলে তো রুজুকৃত মামলা নিষ্পত্তির জন্য বা ন্যায়বিচারের আশায় অসংখ্য মানুষকে বছরের পর বছর আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো না। রুজুকৃত মামলাও এত স্তূপীকৃত হতো না, মামলার কারণে অসংখ্য মানুষকে সহায় সম্পত্তি হারিয়ে নিঃশেষ হতে হতো না। মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ যে, তিনি অসহায় বিচারপ্রার্থী মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করে আইনজীবী, সহকারী আইনজীবী, বিচারপতি, বিচারপ্রার্থীসহ সকলকে আদালতকে সহায়তা করতে বলেছেন। আদালতকে আরো ধন্যবাদ জানাতে চাই যে, অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় আদালতের হস্তক্ষেপ ও সঠিক নির্দেশনার ফলে সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছে। এটা আমাদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই আশান্বিত করে।
বর্তমান ডিজিটাল যুগে আমরা বসবাস করছি। দেশের অধিকাংশ অফিস-আদালতের কার্যক্রম ডিজিটাল অর্থাত্ অনলাইনে সম্পাদিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমির মতো একটি জটিল ও দীর্ঘসূত্রতাপূর্ণ কার্যক্রমকে অত্যন্ত সুন্দর ও সহজভাবে অনলাইন পদ্ধতিতে নিয়ে আসতে পেরেছে। মানুষ ঘরে বসেই খাজনা পরিশোধ থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম কোনো রকম হয়রানি ছাড়াই দ্রুততম সময়ে সম্পাদন করতে পারছে। এজন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়সহ এ মন্ত্রণালয়ের সকলেই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। একইভাবে দেশের সব আদালতের কার্যক্রমও যদি বৃহত্তর পর্যায়ে অনলাইন পদ্ধতিতে আনা যায়, তাহলে এর কার্যক্রমও দ্রুততম সময়ে এবং কোনো রকম হয়রানি ছাড়াই মানুষ এর সুফল পেতে পারে। এর পাশাপাশি প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা মেনে সবাই যদি আদালতকে সহায়তা করেন তাহলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে না। মানুষ সময়মতো সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার পাবে। আইনজীবীসহ মাননীয় বিচারকরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন এবং মানুষের সেবায় এগিয়ে আসার জন্য অবিরাম পরিশ্রম করলে দেশের সব জেলায় সব আদালতে সব ধরনের রুজুকৃত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। আদালতের দ্বারে দ্বারে আর ঘুরতে হবে না। সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে কাউকে নিঃস্ব হতে হবে না। ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় মামলা করতে গিয়ে মানুষকে যেন সর্বস্বান্ত হতে না হয়, বছরের পর বছর যেন আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে না হয়, মানুষ যেন তার জীবদ্দশায় ন্যায়বিচারের রায় দেখে শান্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারেন, বিচারব্যবস্থা যেন তার নিজস্ব গতিতে চলে—মাননীয় আদালতের কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।