জ্বালানি ন্যায়বিচার বলতে গোষ্ঠী, জাতীয়তা, আয় বা ভৌগোলিক অবস্থান-নির্বিশেষে সবার জন্য সমন্যায়পরায়ণতা, ক্রয়ক্ষমতা, অভিগম্যতা এবং জ্বালানি সরবরাহ ও সামগ্রিক জ্বালানিব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বোঝায়। জ্বালানি বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো সব নাগরিকের জন্য সহজলভ্য, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও গণতান্ত্রিকভাবে জ্বালানি পরিচালিত করা এবং বিদ্যুত্-উত্পাদন, সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার নির্মাণ, পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচের অসম ভাগ বা নেতিবাচক প্রভাব থেকে তাদের পরিত্রাণ দেওয়া ও জ্বালানি খাতে সবার ন্যায়সংগত অভিগম্যতা নিশ্চিত করা। মূলত জ্বালানি বিচার হলো একটি নাগরিক বা জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা নীতিগত সম্পৃক্ততার মাধ্যমে কোনো জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যত্ জ্বালানির ব্যবহার টেকসই করতে সম্প্রদায়গত মতামত ও অংশগ্রহণের ওপর জোর আরোপ করে। তাই বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের সব নাগরিকের জন্য নিরবচ্ছিন্ন, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও টেকসই জ্বালানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব ক্ষেত্রে জ্বালানি ন্যায়বিচার নীতি গ্রহণ ও প্রতিপালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ একটি জ্বালানি ক্ষুধার্ত দেশে হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অবশ্য সমগ্র বিশ্বই এখন কোভিড-১৯, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভৃতি কারণে জ্বালানি খাতে একটি বৈশ্বিক সংকট প্রত্যক্ষ করছে। এই বৈশ্বিক সংকট সারা পৃথিবীতে জ্বালানি সরবরাহেও বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ২০২০ সালের এপ্রিলের তুলনায় বর্তমানে আট গুণ ও অপরিশোধিত তেল প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেও মনে করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ তার বিদ্যুত্ বিভ্রাটের অতীত ইতিহাসকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছে। কারণ দেশে গত এক দশকে বিদ্যুত্ খাতে দ্রুত অগ্রগতির ফলে এক পর্যায়ে প্রায় ১০০ শতাংশ চাহিদা পূরণের সক্ষমতা অর্জিত হয়েছিল। ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর গত প্রায় এক যুগে বিদ্যুত্ উত্পাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরবরাহ এবং সঞ্চালন বাড়ানোর ওপর অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক মনোনিবেশ করেছিল। এমনকি এখনো বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা রয়েছে; কিন্তু ক্রমাগত বিদ্যুত্-উত্পাদন অব্যাহত রাখার জন্য টেকসই উত্সকে অগ্রাধিকার না দেওয়ায় এখন সাশ্রয়ী মূল্যে পর্যাপ্ত কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে, সাধারণ একটি গ্রিড ত্রুটি বা প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে পূর্বে স্বল্পসময়ের জন্য যে বিদ্যুত্ বিভ্রাট হতো তা এখন জ্বালানিসংকটের লক্ষণে রূপান্তরিত হয়েছে।
সীমিত সম্পদ এবং অবকাঠামো দিয়ে সবার জন্য সাশ্রয়ী, নিরবচ্ছিন্ন এবং মানসম্পন্ন বিদ্যুত্ নিশ্চিত করা বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। উপরন্তু, সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব, টেকসই মহাপরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণে ব্যর্থতা, প্রশাসনিক অদক্ষতা, সিস্টেম লস, কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা, ক্রমবর্ধমান চাহিদা, বিদ্যুত্সঞ্চালন লাইনের অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ, দুর্নীতি, সীমিত সঞ্চয় সক্ষমতা প্রভৃতি কারণ বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুত্ বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশের বিদ্যুত্-উত্পাদন প্রধানত গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। দেশে বর্তমান গ্যাসের মজুত একই সঙ্গে শিল্পায়ন ও বিদ্যুত্-উত্পাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে, আমাদের বিদেশি বিভিন্ন উত্স থেকে কয়লা, তেল ও গ্যাস আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হতে হয়েছে। তবে এ কথাও স্মরণ রাখা উচিত যে, জীবাশ্ম জ্বালানির আন্তর্জাতিক মজুতও অফুরন্ত নয়। যার দরুন এর দাম এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের সঙ্গে বৈশ্বিক শক্তির খেলা ও রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিক বাজারে জীবাশ্ম জ্বালানি; যেমন :তেল, গ্যাস ও কয়লার বর্তমান ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুত্সংকটকে অনিবার্য করে তুলেছে। আগেভাগেই বিকল্প উত্স অন্বেষণের অভাব এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ও জনপ্রিয় করার অপর্যাপ্ত উদ্যোগ সামগ্রিকভাবে জ্বালানি সরবরাহ এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করেছে।
বর্তমান সরকার ২০১৬ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান নামে বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছিল; যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিবর্তে জীবাশ্মের ওপর গুরুত্বারোপ করে ৩৫ শতাংশ গ্যাস এবং ৩৫ শতাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ঠিক একইভাবে ২০২২ সালে প্রস্তুতকৃত খসড়া মাস্টার প্ল্যানে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে পাশ কাটিয়ে পুনরায় বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ২০২৬ সাল নাগাদ দেশীয় গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে ৭০ শতাংশ আমদানিনির্ভর গ্যাস দিয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জ্বালানিনিরাপত্তা ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে; যার ইঙ্গিত বর্তমান সংকট থেকেও পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রিনহাউজ গ্যাসের প্রভাব কমাতে প্রাকৃতিক জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তাই বাংলাদেশ শিগিগরই জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশের জ্বালানি-ব্যবস্থাপনা গণতান্ত্রিক, দ্রুত জ্বালানি বিচার নীতি প্রতিষ্ঠা ও সময়োপযোগী এবং কার্যকরি সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বড় রকমের জ্বালানিসংকটে পড়তে যাচ্ছে।
পরিতাপের বিষয় হলো বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড জ্বালানি বিচার নীতি অনুসরণ না করে চলতি বছর ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যানবিষয়ক একটি খসড়া তৈরি করেছে, যা পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। যদিও এটি এখন স্পষ্টত যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক জ্বালানিবাজার আরো অস্থিতিশীল থাকবে। উক্ত খসড়ায় নবায়নযোগ্য শক্তি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা, অভ্যন্তরীণ গ্যাস সম্পদ অন্বেষণের প্রয়োজন, ব্যয়বহুল তেলচালিত বিদ্যুেকন্দ্রগুলো ক্রমান্বয়ে বন্ধ করা এবং পাওয়ার সেক্টর সিস্টেম লস কমানোর জন্য কোনো মহাপরিকল্পনা নেই!
বর্তমান বিদ্যুত্ ও জ্বালানি বিপর্যয় থেকে উত্তরণ এবং জ্বালানি আমদানি কমাতে ক্রমান্বয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়াতে এখনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোযোগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পর্যাপ্ত উত্স ও বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশের বর্তমান বিদ্যুত্সমস্যা সমাধান ও টেকসই করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সৌরবিদ্যুত্, বায়ু, জোয়ার-ভাটা, হাইড্রোলজিক্যাল, সোলার থার্মাল, সমুদ্রতরঙ্গ এবং বঙ্গোপসাগরের অসীম শক্তি পরিস্থিতি সামাল দিতে এই মুহূর্তে বৃহত্ পরিসরে ব্যবহার করা উচিত।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞগণ মোটামুটিভাবে অনুমান করেছেন যে, বাংলাদেশের বায়ু এবং সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা যথাক্রমে ৬০ হাজার মেগাওয়াট এবং ৩৫ হাজার মেগাওয়াট। অধিকন্তু একটি বায়ু বা সৌরবিদ্যুত্ প্রকল্প ৯ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য। এছাড়াও আমাদের দেশের বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাবনা শুধু কক্সবাজার বা অন্যান্য উপকূলীয় এলাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার পরে বায়ুশক্তির সরবরাহ ভালো। বায়ুশক্তি থেকে ৮০ মিটার উচ্চতায় ৩৩ হাজার মেগাওয়াট তড়িত্ উত্পাদন করা সম্ভব; আর উচ্চতা ১২০ মিটারে উন্নীত করতে পারলে উত্পাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব। উপরন্তু, বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিভিত্তিক দেশে শুধু কৃষি ফসলের অবশিষ্টাংশ, পশুবর্জ্য ও স্থানীয় বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োমাস ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। জ্বালানির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সুপ্রশিক্ষিত মানবসম্পদ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের উচিত বিদ্যুত্সংকট মোকাবিলায় কিছু আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যার মধ্যে জ্বালানি-ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি ন্যায়বিচারের নীতির সংযোজন ও অনুশীলন, উচ্চহারে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্বল্পমূল্যে স্থানীয় গ্যাস কেনার ওপর জোর আরোপ করা। বিদেশি কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাপেক্সকে শক্তিশালী করার এখনই সর্বোত্তম সময়। কারণ জ্বালানি খাতে নীতিনির্ধারকদের আগের একই ভুলের মূল্য দেশের নাগরিকগণ পুনরায় আর দিতে পারবে না।
একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে একই সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা, পরিবেশগত সুরক্ষা এবং জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। কাজেই বাংলাদেশে ভবিষ্যতে চলমান জ্বালানিসংকট রোধে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য জ্বালানির ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এখনই উপযুক্ত সময়।
লেখক: ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী