আমরা যদি কয়লা উত্তোলন না করি, তাহলে এলএনজি আমদানি ছাড়া কোনো উপায় নেই। ২০১০ ও ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ খাতের জন্য যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা ছিল সম্পূর্ণরূপেই আমদানিনির্ভর। ২০১০ সালে যখন বিদ্যুৎ খাতের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, তখন আমি একটি পরিসংখ্যান দিয়েছিলাম। সেখানে ২০৩০ সাল নাগাদ, অর্থাৎ ২০ বছর পরে আমাদের ৯০ শতাংশ জ্বালানি আমদানি করতে হবে বিদ্যুৎ খাতের জন্য। প্রতি বছর গড়ে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে। এই মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১০ সালের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে। এখন তো মূল্য নিশ্চয়ই আরও অনেক বেড়ে যাবে। আমরা যদি মনে করি, এখনো আগের মতোই বছরে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে বিদ্যুৎ খাতের জ্বালানি আমদানির জন্য, তাহলে সেটা অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করবে। ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ খাতের জন্য জ্বালানি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হলে তখন আমাদের জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করছে, তাতে বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি আমদানির জন্য বছরে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জোগান দেওয়া কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু আমাদের শিল্প উৎপাদন বাড়ছে না। রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না। রেমিটেন্সও বাড়ছে না। শিল্পের বহুমুখীকরণ হচ্ছে না। অর্থাৎ, দেশের অর্থনীতি এখন একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এই পরিমাণ অর্থ জোগান দেওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিদ্যুৎ খাত নিয়ে আমাদের একটা জরুরি ভাব ছিল। প্রথম থেকেই আমাদের ফায়ার ফাইটিংয়ে ব্যস্ততা বেশি। আমরা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলাম। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ব্যর্থ হলেই স্বল্পকালীন পরিকল্পনা গ্রহণের প্রশ্ন আসে। আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখব, ২০০১ সালের সরকার দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। মূলত এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, ২০০৬ বা ২০০৭ সালে বিদ্যুৎ খাতে মারাত্মক ক্রাইসিস শুরু হয়। ঘন ঘন লোডশেডিং হতো। কোনো কোনো দিন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হতো। জনজীবন মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। সেই সময় গুরুতর ক্রাইসিস সৃষ্টি হয়। সেই ক্রাইসিস মোকাবিলার জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের চিন্তাভাবনা করে। কারণ একমাত্র তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমেই দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্রাইসিস সৃষ্টি হয় পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমুদ্রসীমায় ব্রিডিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। সেখানে কিছু কাজও করা হয়েছিল। কিন্তু পরে অজ্ঞাত কারণে এটা ফলোআপ করা হয়নি। পিএসসি, ২০০৮ আমাদের আছে। অবশ্য আরও একটি কারণ এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে। তেল, গ্যাস রক্ষাকারী জাতীয় কমিটি হাইকোর্টে মামলা করে একটি বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছিল। পরে সেই বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হলেও আর কোনো কাজ করা হয়নি। ক্রাইসিস সৃষ্টি হওয়ার কারণেই দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আমদানিকৃত জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এলএনজি বা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো কোনো মহলের বায়াসনেস (পক্ষপাত) তো ছিলই। গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের করতে যে সময় প্রয়োজন হয়, আমদানির ক্ষেত্রে ততটা সময়ের প্রয়োজন হয় না। এছাড়া যে কোনো আমদানির ক্ষেত্রে কমিশনের একটি ব্যাপার থাকে। এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে মহলবিশেষের অতি উত্সাহের পেছনে কমিশনের একটি ব্যাপার থাকতে পারে বলে অভিযোগ শোনা যায়। আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। কারণ আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। ক্রাইসিস পিরিয়ডে দ্রুত সংকট সমাধানের জন্য এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, কিন্তু অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ খাতের ক্রাইসিস মোকাবিলার জন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও তার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সেভাবে নেওয়া হয়নি। কারণ আমাদের পুরো ফোকাসটাই ছিল স্বল্প মেয়াদে সংকট মোকাবিলার ওপর। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চলেছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। দীর্ঘমেয়াদি কয়লাভিত্তিক বড় বড় যেসব প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেখানে আমাদের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের আরও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল। ২০২৭ সালের মধ্যে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার কথা, সেগুলো বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এসব প্রকল্প যদি আমদানিকৃত কয়লার মাধ্যমে পরিচালনা করতে হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে কয়লার যে মূল্য রয়েছে, তাতে প্রতি বছর অন্তত ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কয়লা আমদানি করতে হবে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রেকন্দ্র থেকে ৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। আর গ্যাস আমদানি করতে হবে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহারের জন্য। আমাদের জ্বালানি আমদানির জন্য যদি এত বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে যায়, তাহলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। আমরা ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করছি। আর রপ্তানি করছি মাত্র ৫২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা বাড়ছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের এই বিরাট ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে আমি জানি না। আমদানি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমদানিকৃত জ্বালানির অতিনির্ভরতা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। বলা হয়েছিল, আমাদের অর্থনীতি যেভাবে উন্নত হচ্ছে, তা থেকে জ্বালানি আমদানির ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হবে। কিন্তু অর্থনীতি যদি এই আমদানি ব্যয় বহন করার মতো অবস্থায় না থাকে, তাহলে সমস্যা হতে পারে। প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের সামনে আসছে। আমরা যদি এলএনজি আমদানি করতে না পারি, তাহলে প্রকল্পগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ একেবারে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে। যদিও যুদ্ধ না হলেও আমরা ডলারের সংকটে পড়তাম।
এখন এই মুহূর্তে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। আমরা রেশনিং করছি, দাম বাড়াচ্ছি শিল্পক্ষেত্রে। শিল্প ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না, বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। অথচ শিল্পই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। শিল্প খাতে বিদ্যুৎ, গ্যাস জোগান দিতে না পারার অর্থই হচ্ছে আমি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছি। শিল্প যদি স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে রপ্তানি ব্যাহত হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। ফলে দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা টাকার অভাবে তেল, গ্যাস আমদানি করতে পারছি না। আবার শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন চালাতে পারছি না। যে কোনো মূল্যেই হোক, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, শিল্প-কারখানাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের জোগান পাবে। তারা যাতে স্বাভাবিক গতিতে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। আমাদের কনজারভেশন অ্যান্ড ইফিসিয়েন্সি বাড়াতে হবে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে, কীভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস কম ব্যবহার করে উৎপাদন ঠিক রাখা যায়। সব পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে। মেশিনারিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি হারে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। রুফটপ রিনিউয়েবল এনার্জি উৎপাদনের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। রিনিউয়েবল এনার্জির ক্ষেত্রে ট্যাক্স ফ্রি সুযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে গ্যাস, কয়লা অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে নিজস্ব খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করে তা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ, আমাদের সমস্যার একক কোনো সহজ সমাধান নেই। দক্ষতা, সাশ্রয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বহুমুখী সমাধান খুঁজতে হবে।