একসময় প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেওয়া হতো। এখন মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের বিরাট অর্জন বলা যায়। এতে সরকারের বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু এর সুফল বেশিদিন ভোগ করতে পারে না শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। বছরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই পাওয়ার পরও অভিভাবকদের বইকেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকে। কারণ বছরের শুরুতেই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে অতি উচ্চমূল্যের কিছু গাইড বই বেসরকারিভাবে পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয়। গাইড বইগুলোর ওপর জোর দিয়ে পড়ানো হয় বলে শিক্ষার্থীরা সেগুলো কিনতে বাধ্য। টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃক বিনামূল্যে সরবরাহকৃত ইংরেজি গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ বই দুটি যথেষ্ট মানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও অতি উচ্চমূল্যের গ্রামার ও ব্যাকরণ—বই দুটি শিক্ষার্থীদের কিনতে হয়। প্রকাশকরা তেমন কিছু পরিবর্তন না করে কিংবা সামান্য কিছু পরিবর্তন করে প্রতিবছর নতুন মোড়কে বইগুলো বাজারে ছাড়ে। শিক্ষার্থীদের কাছে গৌণ হয়ে যায় বিনামূল্যের পাঠ্যবই আর বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে উচ্চমূল্যের গাইড বই!
বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনিটরিং করতে দেখা যায় না খুব একটা। স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় উচ্চমূল্যের গাইডবই বিক্রি হচ্ছে। প্রথম শ্রেণি থেকে গাইডনির্ভর হয়ে যাচ্ছে শিশুরা। এ পরিস্থিতিতে সরকার গাইডবই নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা কাগজে-কলমেই আটকে আছে। শিক্ষকরা গাইডবই পড়াতে পারবেন না মর্মেও নির্দেশ জারি করা হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক এই বিশাল বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না কেউ।
সাধারণ জনগণের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থীদের অভিভাবক। তাঁদের টাকা ট্যাক্সের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে বিভিন্ন খাতে খরচ করে সরকার। সে দিক থেকে সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের ব্যয়ভার বহন করেন অভিভাবকগণ। আবার উচ্চমূল্যের গাইড কেনার ব্যয়ভার বহন করতে হয় তাঁদেরই। তাহলে সন্তানদের শিক্ষাব্যয় হ্রাস হলো কীভাবে? বাধ্যতামূলকভাবে উচ্চমূল্যের গাইডবইয়ের বিক্রি যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান করার বিষয়টি অর্থহীন হয়ে যাবে। বাস্তবে তাই হয়েছে। বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদানের পরও বইকেনা বাবদ অভিভাবকদের ব্যয় কমেনি। এদিকে কাগজের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বইয়ের দাম বেড়েছে। প্রকাশকদের কোনো ক্ষতি নেই। শিক্ষক সমিতিকে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দিয়ে শিক্ষকদের ব্যবহার করেই প্রকাশকরা শিক্ষার্থীদের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে উচ্চমূল্যের গাইডবই।
বছরের প্রথম দিন উৎসবমুখর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়। সরকারের এই বদান্যতায় সবার সন্তুষ্ট হওয়ারই কথা। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আদরের সন্তানটি স্কুল থেকে খবর নিয়ে আসে ‘এই বই কিনতে হবে’, ‘সেই বই কিনতে হবে’ ইত্যাদি। স্কুল থেকে শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে প্রণীত বুকলিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের হাতে। কোন অভিভাবকের এত বড় বুকের পাটা যে, সেই বুকলিস্টকে অবজ্ঞা করেন। বইয়ের দোকানি জানে নির্দিষ্ট স্কুলের শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বইগুলো কিনতেই হবে। সবগুলো বই সেট মিলিয়ে বেঁধে রাখা হয়। একটাও কম কেনা যাবে না। মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে পুরো সেটের। নিরুপায় অভিভাবক। একদিন দেরি করা মানে পিছিয়ে যাওয়া। কারণ শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন ঐ গাইডবই থেকেই।
টেক্সবুককে গৌণ করে পরিকল্পিতভাবে উচ্চমূল্যের গাইডবই চাপিয়ে দেওয়ার এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে পদ্ধতিগত কারণেই রেহাই পাওয়া যাবে নতুন পাঠক্রম অনুসারে। নতুন পাঠক্রম অনুসারে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করে দেওয়া কোনো গাইড বা সহায়ক বই থাকবে না। দলগতভাবে বা দুজন মিলে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে। প্রথম স্থান অধিকার কিংবা এ প্লাস পাওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে হবে না কোনো শিক্ষার্থীকে। কোনো কল্পনাবিলাসী ভাবাবেগ ও মনোজাগতিক উন্নতির তাত্ত্বিক দিকগুলোর চেয়ে যাপিত জীবনের নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বর্তমান পাঠক্রমে। ফলে এখন সব শিক্ষাই ব্যবহারিক শিক্ষা হয়ে উঠবে। কোচিং ও গাইডবাণিজ্যের অনৈতিক চাপ থেকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ রেহাই পাবেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে কোনো শাখা না থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের এই ভালো দিকগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে—শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সবার এই প্রত্যাশা।