বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থেকেই অনেক ধরনের সমস্যা চলছে। যেমন, বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয় কিংবা উপযুক্ত জমি পাওয়া যায় না। সরকার এর জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল ও এক দরজায় সেবা (ওএসএস) চালু করেছে। এগুলো এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন ও কার্যকর হয়নি। অর্থাৎ বিনিয়োগে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কোনো উদ্যোগই চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়নি। এর সঙ্গে ডলার-সংকট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি বিষফোড়া হিসেবে যুক্ত হয়েছে।
ডলার-সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি রয়েছে। ফলে অনেক জটিলতা থাকা সত্ত্বেও যতখানি বিনিয়োগ হওয়ার কথা সেটাও আসেনি। ডলার-সংকটের কারণেই বর্তমানের এই জ্বালানি-সংকট। দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ গ্রহণের সীমাও ৩ কোটি ডলার থেকে ২ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের বলার মতো কোনো উন্নতি হয়নি, বরং গত এক বছরে তিনটি সূচকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এমন চিত্রই উঠে এসেছে বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২২-২৩ জরিপে। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত জরিপের তথ্যানুযায়ী, ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পাওয়া জটিল আকার ধারণ করেছে। কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি আগের চেয়ে বেড়েছে। আবার কারখানা বা ব্যবসার জন্য জমি পাওয়াটাও আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে। বিবিএক্স জরিপটি করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ। বর্তমানে জ্বালানি-সংকটে দেশীয় শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহী হচ্ছেন। এ সমস্যা সমাধানে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন ছিল। দেশের করব্যবস্থা নিয়ে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগকারীর অনেক অভিযোগ রয়েছে। কয়েক দফায় কমানোর পরও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সার্বিক করের পরিমাণ অনেক বেশি। কর আরও কমানো দরকার। এ ছাড়া ভ্যাটের একাধিক হার কমিয়ে আনার পাশাপাশি এই ব্যবস্থাকে আরও সহজ করা হলে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে ২৯০ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল। আর গত বছর আসে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ। তার মানে গত বছর ৫৫ কোটি ডলারের এফডিআই বেশি এসেছে। তবে মূলধন বা নতুন বিনিয়োগ কমেছে, বেড়েছে পুনর্বিনিয়োগ। ডলার-সংকটের কারণে অনেক কোম্পানি নিজ দেশে মুনাফা নিতে পারেনি। এ কারণে কাগজে কলমে পুনর্বিনিয়োগ বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এই অর্থের পুরোটা বিনিয়োগ হয়েছে, তা বলা যাবে না। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এফডিআই জিডিপির ৩-৪ শতাংশ করার কথা ছিল। জিডিপির ৩ শতাংশ ধরলেও প্রায় ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই আসা উচিত ছিল। সেখানে আমাদের বর্তমান অবস্থান খুবই নগণ্য। সার্বিকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো নয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল ২৮ শতাংশ। তবে সেই জায়গায় পৌঁছানো যায়নি। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবার আগে রিটার্ন নিয়ে চিন্তা করেন। যখন তারা দেখেন পদ্ধতিগত কিছু সমস্যার কারণে ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটে, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ করতে চান না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সব দোষ ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর চাপানোর সময়টা পার হয়ে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশই অসুবিধায় পড়েনি। অন্যান্য দেশে এখন মূল্যস্ফীতি কমছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারছে না। এ জন্য সমস্যার মূল কারণগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্রুত সেগুলো সমাধান করতে হবে। যুদ্ধের ওপর দায় চাপানোর কৌশল থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিনিয়োগ সেবার মান উন্নত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, অধিক বিনিয়োগ মানে অধিক কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নের পথে আরও এগিয়ে যাওয়া। অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল আয়োজন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগের জন্য সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এ তালিকায় সিঙ্গাপুর ও দুবাই রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া অন্যতম। আমাদের ইমেজ সংকট রয়েছে। এই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ করতে হবে। বাংলাদেশে অনেক সুযোগ আছে বিনিয়োগ করার। সম্ভাবনাও অনেক। গত চার বছরে বাংলাদেশের জিডিপির আকার চার গুণ বেড়েছে। এখানে শিক্ষিত, উদ্যমী, পরিশ্রমী জনশক্তি রয়েছে। লজিস্টিকস খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ২০৪১ সালের বাংলাদেশের জন্য প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় লজিস্টিকস খাতকে একটি প্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দুটি কর্মকৌশলের ওপর ভিত্তি করে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো—অধিকতর সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণ। এ দুটি কৌশল সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন একটি গতিশীল লজিস্টিক খাত। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবহন ও অবকাঠামো খাতে প্রায় ২৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। এবং এ খাতসমূহের প্রদত্ত সেবার জন্য বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। ব্যবসার আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে এ বাজারও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির মূল্য বর্তমানের ৩৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার হতে অচিরেই বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৫ সালে প্রায় ৫৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এছাড়া আমদানি পণ্যের মূল্যও বর্তমানের ৫১ বিলিয়ন ডলার হতে বৃদ্ধি পেয়ে ৮৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধির সঙ্গে পণ্যাগার, সংরক্ষণাগার, কোল্ড চেইন ব্যবসা, সড়ক, নৌ, সমুদ্র এবং বিমানপথে পণ্য পরিবহন, নৌ, বিমান ও স্থলবন্দরের কার্যক্রম আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। এর জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।