বিপদ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। ইমিগ্র্যাশন নিয়ে হযবরল অবস্থার মধ্যেই উপনির্বাচনে লজ্জাজনক হার হলো তার দলের।
ব্রেক্সিট-উত্তর ব্রিটেনের নানামুখী সমস্যা সামাল দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন সরকার একের পর এক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করছে। কিন্তু স্বল্পতম সময়ে এত সংস্কার উলটো লেজে-গোবরে অবস্থা তৈরি করছে। বহুল সমালোচিত ইমিগ্র্যাশন ইস্যু নিয়ে চলছে হযবরল অবস্থা। একটি সংস্কারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন খাতে। পরিসংখ্যান বিবেচনায় বৈধ-অবৈধ উপায়ে দল বেঁধে মানুষ ঢুকছে দেশটিতে। অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে নতুন ‘ইল্লিগ্যাল মাইগ্র্যাশন বিল’ যখন পাশ হয়, তার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসী প্রবেশ করেছে ৫৭৪ জন। বাড়ি বিক্রি কমে যাওয়া এবং ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় একই বাড়িতে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। তার ওপর ইমিগ্র্যান্টদের ঢল নামার কারণে বাড়িভাড়া আকাশ ছুঁয়েছে। বাড়ি কেনার জন্য ঋণের সুদের হার অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এ বছর বাড়ি বিক্রি কমতে পারে ১৮ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তাদের সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে। এ কারণে বাড়ি বিক্রিতে ধস নামার উপক্রম হয়েছে। সরকারি হিসাবে মুদ্রাস্ফীতি কমেছে। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রতিফলন না থাকায় মানুষ ক্ষুব্ধ। আগামী নির্বাচনের আগে ঋষি সুনাকের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ইমিগ্র্যান্টদের লাগাম টেনে ধরা। এখন পর্যন্ত সাফল্য আসার মতো কিছু করতে পারেননি তিনি। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আফ্রিকার রুয়ান্ডায় পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা-ও আটকে দিয়েছে আদালত। নেট ইমিগ্র্যাশন কমানোর জন্য টাগের্ট করেছিলেন স্টুডেন্ট ডিপেনডেন্টদের। জানুয়ারি থেকে স্টুডেন্ট ভিসাপ্রাপ্তদের অধিকাংশই তাদের বউ-বাচ্চাদের ব্রিটেনে নিয়ে আসতে পারবে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজস্ব আহরণ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। শিক্ষা সেক্টরের এই শঙ্কার মধ্যেই হাজার হাজার বিদেশি ছাত্রছাত্রী টিউশন ফির চাপ এবং পারিবারিক ইস্যুর সমাধানে বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছে ওয়ার্ক পারমিটের সুযোগকে। আমার পরিচিত এক ছাত্রীর ভাষ্য অনুসারে, তার সেশনে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৫০ জনের মতো বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল, যাদের অধিকাংশই আংশিক টিউশন ফি দিয়ে ব্রিটেনে এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে টিউশন ফি পরিশোধের চাপ শুরু হলে তারা একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দেয়। উক্ত ছাত্রীর দেওয়া তথ্য সত্য হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পর্যন্ত কম-বেশি ৫০ জনের মতো বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল। এমতাবস্থায় সরকারের ওপর বিশ্ববিদ্যালগুলোর চাপ বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাতে সরকার ছাত্রাবস্থায় ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ করেছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়েছে। সাধারণত পার্লামেন্টে কোনো বিল উত্থাপন করা হলে আলোচনা ছাড়াই বিল উত্থাপনের দিন থেকে ২১ দিন পর সরকার চাইলে তা বাস্তবায়ন করতে পারে। এক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করার মাধ্যমে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেটা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এদিকে ইমিগ্র্যাশনের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা অপব্যবহারের অভিযোগে পাঁচটি দেশের নাগরিকদের জন্য বিশেষ শর্ত আরোপ করা হয়েছে। দেশগুলো হলো ডমিনিকা, হন্ডুরাস, নামিবিয়া, তিমোর লেস্ট ও ভেনোয়েটা। অদূর ভবিষ্যতে আরো দেশের ওপর এ ধরনের শর্ত আরোপ করা হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ রহিত করার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, গত মাসব্যাপী হাজার হাজার সার্টিফিকেট অব স্পনসর, যা ওয়ার্ক পারমিটের জন্য দেওয়া হয়, এদের বেশির ভাগই ছিল বিদেশি শিক্ষার্থী, যারা ভিসা পরিবর্তনের জন্য আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে ভিসা পরিবর্তন বন্ধ করার ফলে এই সার্টিফিকেটগুলো এখন কোনো কাজে আসবে না। ফলে সার্টিফিকেটগুলোর বিপরীতে লাখ লাখ পাউন্ড না পেয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের মুখে পড়েছে। সুতরাং সামনে ব্যবসায়ীদের চাপটা দৃশ্যমান হবে এটা অনুমান করাই যায়।
বর্তমানে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন হোটেলে রেখে থাকে, যার কারণে সরকারের বিপুল অর্থ খরচ হচ্ছে। এই খরচ কমানোর জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা বিভিন্ন পরিত্যক্ত জাহাজে তাদের রাখার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এখানেও তাদের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। ইতিমধ্যে ব্রিটেনের উইরাল, লন্ডন ও স্কটল্যান্ডের তিনটি ডকইয়ার্ড এ ধরনের জাহাজ রাখতে অস্বীকার করেছে।
এদিকে, নেট মাইগ্র্যাশনের চাপ কমানোর দৌড়ঝাঁপের মধ্যেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মানবসম্পদ ইস্যুতে আসছে খারাপ সংবাদ। স্টাফ সংকটের সমাধানের জন্য ইতিপূর্বে কেয়ার সেক্টরে ব্রিটেনের বাইরে থেকে স্টাফ নিয়োগ সহজ করেছেন। চলতি সপ্তাহে আরো যোগ হয়েছে কনস্ট্রাকসন খাতও। এই খাতেও এখন নিয়োগদাতারা বিদেশ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন।
এসব সমস্যার মধ্যেই ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সাভির্সের জুনিয়র ডাক্তাররা দুই দফায় লম্বা কর্মবিরতি পালন করেছেন। শত অনুনয়বিনয় সত্ত্বেও ডাক্তাররা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় ঋষি সুনাক তাদের বেতন সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমানে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে এ ধরনের বেতন বৃদ্ধির সক্ষমতা নিয়ে সরকার নানা সময়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছিলেন। তবে এ সপ্তাহে ঘোষিত বেতন বাড়ানোর অর্থসংস্থানের খাত হিসেবে ঋষি সুনাক টাগের্ট করেছেন ইমিগ্র্যান্টদের। বেতন বাড়ানোর এই অর্থ সংস্থানের উদ্দেশ্যে ব্রিটেনে আসতে ইচ্ছুক ইমিগ্র্যান্টদের বর্তমানে স্বাস্থ খাতে যে ফি দিতে হয়, তা অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। সরকার বলছে, ফি বাড়ানোর মাধ্যমে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন পাউন্ড সংস্থান করতে পারবে।
সমস্যাক্রান্ত সরকারের এই সময়ে তিনটি আসনে উপনির্বাচনে অস্বাভাবিক খারাপ ফলাফলে বাড়তি চাপে পড়েছেন ঋষি সুনাক। একটি আসনে গত নির্বাচনে ২০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হলেও উপনির্বাচনে বিপুল ভোটে হেরেছেন। অর্থাৎ, গত নির্বাচনে ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভকে ভোট দিয়েছিলেন এরকম ১০০ ভোটারের মধ্যে অন্তত ২০ জন এবার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে দিয়েছেন।