বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করলে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বয়কট করতে পারে। দেশে রাজনৈতিক বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠার অভিযোগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) শীর্ষ এক নেতা নির্বাচন বয়কটের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বিএনপির শীর্ষ এক নেতা বলেন, শেখ হাসিনার উচিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানো এবং একটি নিরপেক্ষ-তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তার জায়গায় নিতে দেওয়া, যাতে আগামী বছরের জানুয়ারিতে আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে বিরোধী দল। সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থার সদস্য আবদুল মঈন খান বুধবার (১ নভেম্বর) বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ভুয়া নির্বাচনে যাবে না। তিনি বলেন, সরকার ভুয়া নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচন করতে চায়, আমরা তা বৈধতা দেব না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে এবং জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সম্প্রতি তাকেও আটক করা হয়।
গত মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের জন্য দেশের মহাসড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধের ঘোষণা দেয় বিএনপি। ব্যাপক বিক্ষোভের ফলে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে মানুষ মারা গেছে।
অবরোধের দ্বিতীয় দিন বুধবার রাজধানী ঢাকার একটি স্কুলের সামনে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, আরও একজন সন্দেহভাজন পলাতক রয়েছে। এর একদিন আগে পুলিশ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মোট তিনজন নিহত হন বলে জানা গেছে। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সহিংসতায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
সরকার সহিংসতার জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছে। অন্যদিকে বিএনপি অভিযোগ করেছে, আওয়ামী লীগের কর্মীরা সহিংসতা উস্কে দিতে এবং একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য সমাবেশে অনুপ্রবেশ করেছিল।
বাংলাদেশের একটি প্রথম সারির পত্রিকার বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৮ অক্টোবরের বিশাল সমাবেশের সময় সংঘটিত সহিংসতা থেকে দলকে মুক্ত রকাহতে ঢাকার দূতাবাস ও হাইকমিশনে সাত পৃষ্ঠার একটি চিঠিও পাঠিয়েছিল বিএনপি। সেদিনের সমাবেশে হামলার পেছনে কারা রয়েছে, তা বিশ্লেষণের জন্য বিএনপি নেতারা এখন ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করছেন।
জানুয়ারির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য শেখ হাসিনার পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে বিএনপি। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক সংকট যখন আরও খারাপ হচ্ছে, পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শেখ হাসিনাকে শিগগিরই একটি সমাধান বের করতে হবে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সময় বাংলাদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে ‘অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগের’ অভিযোগ করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন, অনেক বাংলাদেশি বলেছেন, তারা সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন। কারণ সরকার বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার এবং ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের জোর দেওয়া উচিত যে, বিরোধী দলকে টার্গেট করা, হয়রানি করা এবং কারাগারে রাখা হলে নির্বাচন সুষ্ঠু বলে বিবেচিত হতে পারে না।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি জোর দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক অংশীদারদের পরিষ্কার করে বলা উচিত যে, কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের অপব্যবহার করায় তারা বাংলাদেশের সঙ্গে আগের মতো ব্যবসা চালিয়ে যাবে না। তাদের উচিত বিরোধী দলকে গণগ্রেফতার ও লক্ষ্যবস্তু বানানোর নিন্দা জানানো। বাংলাদেশ যদি এর অপব্যবহার থেকে সরে আসতে ব্যর্থ হয়, তবে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিণতি নির্ধারণ করা।
যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান এবং দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সকল দলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার গত মঙ্গলবার বলেন, আমরা বিশ্বাস করি সংলাপ জরুরি। আর আমরা বাংলাদেশে যা চাই, বাংলাদেশের জনগণও তাই চায়- শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু অনুষ্ঠিত হোক।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ও ‘সব রাজনৈতিক পক্ষকে সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য এবং সহিংসতায় উসকানি দিতে পারে- এমন কোনো বক্তব্য বা কর্মকাণ্ড এড়ানোর’ আহ্বান জানিয়েছে।
গত ২৬ অক্টোবর বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, দেশের কারাগারগুলো ‘আমাদের দলের নেতাদের’ দ্বারা পূর্ণ রয়েছে।
বিএনপির অভিযোগ, চলতি বছরের জুলাই মাসে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে একই ধরনের বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থেকে দলের অন্তত পাঁচ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষকে শত শত মামলায় আসামি করা হয়েছে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা কারাগারে নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। বিএনপি নেতা শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি দাবি করেন, আটক অবস্থায় তাকে মারধর করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বন্দীদের ওপর নির্যাতন ও অন্যান্য নির্যাতনের সমস্ত অভিযোগ পুরোপুরি এবং স্বাধীনভাবে তদন্ত করা উচিত। দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।