বাবা-মায়ের ‘বিচ্ছেদ’ সন্তানের কাছে একটি ভয়াবহ এবং নির্মম বাস্তব শব্দ। যদিও বিচ্ছেদকে এই আধুনিক সময়ে অনেক নারী তাদের ‘মুক্তি’ ও ‘সাহস’ হিসেবে দেখেন। স্বাভাবিকভাবেই দিন যত যাচ্ছে, নানা পারিবারিক ও সামাজিক কারণে বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসাবমতে, রাজধানী ঢাকা শহরে ২০২০ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল ৯ হাজার ৭৮৭টি আর ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৯১৯টি। এসব বিবাহবিচ্ছেদের কারণে সন্তানের অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত মামলা ও জটিলতাও বাড়ছে। দেখা যায় যে, বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাকে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের জন্য আইনি লড়াই করতে হয়। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও পরীক্ষার ফরম পূরণে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম উল্লেখ করার নিয়ম কয়েক দশক আগেই চালু হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি ফরমে ‘বাবার নাম’ উল্লেখ করতে না পারেন, তার তখন কী হবে? এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালে।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগে এক তরুণী শিক্ষার্থী তথ্য ফরমে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বাবার নাম পূরণ করতে পারেন না। এজন্য ‘মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহী’ সেই তরুণীকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রবেশপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে এ ঘটনা অনুসন্ধান করে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এবং সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং নারীপক্ষ যৌথভাবে জনস্বার্থে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট রিট দায়ের করে। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ঐ বছরের ৩ আগস্ট বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহম্মেদ এবং বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মানবাধিকার, সমতার পরিপন্থি ও বিশেষভাবে শিক্ষার অধিকারে প্রবেশগম্যতার বাধাস্বরূপ বিদ্যমান বৈষম্যমূলক এ বিধানকে কেন আইনের পরিপন্থি এবং অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করা হবে না—মর্মে রুল জারি করেন। পরে ২০২১ সালের ৬ জুন ব্লাস্ট আবেদনকারীদের পক্ষে একটি হলফনামা আদালতে দাখিল করে।
সত্য এই যে, মায়ের একক অভিভাবকত্বের আইনি স্বীকৃতি এখনো বাংলাদেশে অধরা আছে। অভিভাবক ও প্রতিপাদ্য আইন অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সি সন্তানকে নাবালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব মুসলিম শরিয়া আইন, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং অভিভাবক এবং প্রতিপালন আইন, ১৮৯০ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বহুকাল ধরে আমাদের সমাজ পুরুষশাসিত ছিল। ‘নারী’ শব্দের বাংলায় প্রচলিত শব্দ হলো—‘মহিলা’, অর্থাৎ যারা মহলে (ঘরের মধ্যে) থাকবে। নারীরা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে—এটাই যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ছিল। সে কারণে সন্তানের ভরণপোষণ লালনপালন অভিভাবকত্ব—সবকিছুই ছিল পুরুষের অধীনে। একসময় এটাও বলা হতো, পুরুষের তুলনায় নারী দুর্বল, এজন্য নারীরা অন্দরে থাকবে। নারীর মস্তিষ্কের আকার ছোট, নারীর বুদ্ধি কম—সুতরাং নারীরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল কোনো পদে থাকবে না। কিন্তু সেই দিন আর নেই। আধুনিক সময়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ঘরে-বাইরে সুনামের সঙ্গে সমানতালে শিক্ষায়, কর্মে—সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে। বিজ্ঞানও নারীর সক্ষমতার পক্ষেই কথা বলে। যেমন :২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নিউরোসাইকিয়াট্রি ও বিজ্ঞানী লয়ান ব্রিজেনডাইন তার ‘দ্য ফিমেল ব্রেইন’ নামের গবেষণাগ্রন্থে বলেছেন, নারীর মস্তিষ্ক পুরুষদের চেয়ে মালটি-টাস্কিংয়ে বেশি সক্ষম। এবং মস্তিষ্কের আকার কিছুটা ছোট বলে বুদ্ধি কম—এটা সম্পূর্ণ অমূলক ধারণা। তা-ই যদি হয়, তাহলে মানুষের চেয়ে হাতির বুদ্ধি বেশি হওয়ার কথা। কারণ, হাতির মস্তিষ্ক মানুষের চেয়ে প্রায় চার গুণ বড়। সুতরাং নারী যে বুদ্ধিতে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই এবং পুরুষের সমান সুযোগসুবিধা পেলে নারীরাও বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করতে পারে এই আধুনিক যুগে তার হাজার হাজার উদাহরণ দেওয়া যাবে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, বংশগতি। মনে করা হয়, পুরুষদের এক্স ও ওয়াই লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজমের মাধ্যমে মানবজাতির বংশগতি নির্ধারিত হয়। নারী যেন এখানে ব্রাত্য! যদিও প্রাচীনকালের সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কারণ, মায়েদেরই সন্তান ধারণ করতে হয় এবং প্রাচীন ইতিহাস বলে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্ন তৈরি হওয়ার আগে সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে চিন্তিতই ছিল না প্রাচীন মানবজাতি। মজার ব্যাপার হলো, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৮ মে ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়ার ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ’ নামের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বংশপরম্পরার কথা এতকাল শুধু ‘পুরুষ’তান্ত্রিকতার মধ্যে আটকে ছিল। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, মানুষের বংশপরম্পরায় প্রকৃত ভূমিকা রাখে ‘নারী’। এটাকে বরং ‘মাতৃপরম্পরা’ বললেই সঠিক হয়। কারণ, বিজ্ঞান আরো স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে—আমাদের সবার মধ্যে এক বিশেষ ধরনের ডিএনএ (মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ) থাকে—যা শুধু ‘মায়ের’ কাছ থেকেই আসে, পুরুষের কাছ থেকে আসে না। এমনকি বিজ্ঞান আমাদের আদি মায়ের নাম দিয়েছে—‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ’। অর্থাৎ বিজ্ঞান অনুযায়ী বংশপরম্পরা অর্থে পুরুষপরম্পরার পরিবর্তে ‘মাতৃপরম্পরা’ই সঠিক প্রতিশব্দ বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ একজন সন্তানের জন্য মায়ের চেয়ে বড় জায়গা আর নেই। বিজ্ঞানের এত কথার মূলেও রয়েছে বিশেষ ক্ষেত্রে সন্তানের ব্যাপারে মায়ের একক অভিভাবকত্বের প্রশ্ন। এখনো বাংলাদেশে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মায়েদের একক অভিভাবকত্বের মীমাংসা হয়নি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রতিবেশী ভারত এবং বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে মায়ের একক অভিভাবকত্বের কিছু রায় পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। ২০২২ সালের জুলাইয়ে কেরালা হাইকোর্ট এক রায়ে জানিয়েছিল, কোরআন কিংবা হাদিসে একজন মুসলিম নারীর সন্তানের অভিভাবক হওয়ার অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো বাধা না থাকলেও আইনানুযায়ী একজন মুসলিম নারী তার নাবালক সন্তান এবং সম্পত্তির অভিভাবক হতে পারেন না। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছিল, আধুনিক যুগে নারীরা অনেক এগিয়েছেন। অনেকেই প্রায় পুরুষদের কাজের সঙ্গে সমান সমান টক্কর দেন। এছাড়াও বহু ইসলামিক দেশ কিংবা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নারীরা রয়েছেন। মহাকাশ মিশনে অংশগ্রহণ করছেন নারীরা। কিন্তু আইন এখনো নারীদের সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ ও অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে সমানাধিকার দিচ্ছে না।
তবে বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানের যৌথ হেফাজত ও অভিভাবকত্বের বিষয়টির আইনগত স্বীকৃতি আছে কিছু দেশে। এই স্বীকৃতি প্রথম মেলে সুইডেনে ১৯৭৬ সালে। এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হচ্ছে, সন্তানের প্রতি বাবা-মা উভয়ের রয়েছে অধিকার। এটা তো অবশ্যই সত্য যে, সাধারণভাবে সন্তানের প্রতি মায়ের পাশাপাশি বাবাদেরও স্নেহ-ভালোবাসা অসীম। সুতরাং পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় সন্তানের যৌথ হেফাজতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বটে। কিন্তু যদি একক অভিভাবকত্বের প্রশ্ন চলেই আসে, তাহলে উন্নত বিশ্বে বাবার আগে মাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বাংলাদেশে যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাকে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের জন্য আইনি লড়াই করতে হয়, ঠিক উলটোভাবে পশ্চিমা দেশগুলোতে বাবাকে এমন অধিকারের দাবিতে আদালতে ঘুরতে হয়।
অভিভাবকত্ব আইন ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ জটিল। ভারতে ১৯৫৬ সালের আইনে বলা হয়েছিল, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চা মায়ের কাছে থাকবে। তারপর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বাবার অধিকার বেশি। কিন্তু পরে এটা নিয়ে প্রচুর মামলা হয়েছে সেই দেশে। আদালত তাতে যে রায় দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, বাচ্চার স্বার্থ সবার ওপরে। তাই বাচ্চার স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে জানিয়েছে আদালত। ২০২২-এর জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় হলো, বাচ্চা কার অধিকারে থাকবে, সেখানে একটাই মাপদণ্ড থাকবে—বাচ্চার কল্যাণ যিনি সবচেয়ে বেশি করতে পারবেন, তার কাছেই সন্তান থাকবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অভয় ওকার মতে, সন্তানের অধিকার বাবা, না মা—কার কাছে থাকবে, তা ঠিক করার কোনো স্ট্রেট জ্যাকেট ফর্মুলা নেই। এটা একটি জটিল মানবিক বিষয়। সেখানে একটাই কষ্টিপাথর থাকবে, বাচ্চার কল্যাণ কে সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারবে। ২০২২-এর জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, বাচ্চা তো বাবা-মা দুজনেরই কাছে থাকতে পছন্দ করবে। যদি একান্তই বাবা ও মা একসঙ্গে থাকতে না পারেন, যদি বিচ্ছেদ করতেই হয়, তাহলে বাচ্চার অধিকার থাকবে, বাবা ও মা দুজনের কাছেই যাওয়ার। বাবা ও মা দুজনেরই ভালোবাসা ও স্নেহ পাওয়ার। বাবা ও মায়ের মধ্যে যত বিরোধই থাকুক না, মা কখনোই বাবাকে তার সন্তানের সঙ্গে দেখা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না।
অর্থাৎ আইন থেকে বেরিয়ে এসে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো বিষয়টি দেখেছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। কার কাছে সন্তান থাকবে, সেটাও নির্ধারিত হচ্ছে—কে ঐ বাচ্চার কল্যাণ করতে পারবে, কার কাছে থেকে সন্তান ঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে, তার ওপর। কিন্তু যদি এমন হয়, বাবা সন্তানের দেখাশোনা করেন না, খোঁজখবর নেন না, অথবা সন্তানটি যদি হয় অবিবাহিত কোনো নারীর? তখন সেই সন্তানের পিতৃপরিচয় কী হবে? মা কি একক অভিভাবক হতে পারেন না? ভারতে এ সংক্রান্ত একটি যুগান্তকারী রায় রয়েছে। ২০১৫ সালের ৬ জুলাই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই সংক্রান্ত একটি মামলার রায়ে বলেছে, ‘অবিবাহিত মায়েরা চাইলে সন্তানের আইনি অভিভাবকের স্বীকৃতি পেতে পারেন। এক্ষেত্রে বাবার সম্মতির কোনো প্রয়োজন নেই এবং বাবার নাম প্রকাশেরও কোনো প্রয়োজন নেই।’ মজার ব্যাপার হলো, সন্তানের অভিভাবকত্ব চেয়ে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন যেই অবিবাহিত নারী এবং দিল্লির ট্রায়াল কোর্ট ও দিল্লি হাইকোর্ট ঐ নারীর আবেদনের বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছিলেন। সন্তানের অভিভাবকত্ব পেতে হলে বাবার নাম প্রকাশ করে তার সম্মতি প্রয়োজন বলে একজন নারীর করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল হাইকোর্ট। কিন্তু সেই নারী ২০১১ সালে শীর্ষ আদালতে আবেদন করেন এবং সেখানে তিনি ‘মায়ের একক অভিভাবকত্বের’ যুগান্তকারী রায় পান।
আসলে মা হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ নারী, যিনি গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম তথা সন্তানকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে জগতের সবচাইতে উপযুক্ত ব্যক্তি। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং মাদারস জেনেটিকস’ নামের এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, মায়ের সঙ্গ, ছোঁয়া, আবেগ শিশুর আইকিউ উন্নত করে। একজন শিশুর বুদ্ধিমত্তা নির্ভর করে তার মায়ের জিনের ওপর। গবেষণায় দেখা যায়, শিশুর ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট (আইকিউ) কতটা উন্নত হবে তা নির্ভর করে কন্ডিশনিং জিনের ওপর। এই জিন শিশু তার মায়ের কাছ থেকে পায়। সুতরাং মাতৃত্বের জয় হোক, স্বীকৃতি মিলুক বিশেষ ক্ষেত্রে মায়ের একক অভিভাবকত্বের।