আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি (২০০০ সাল), বাংলাদেশে তখন সব মিলিয়ে ডজনখানেক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। আমার মনে আছে, ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলে সে সময় ভর্তি পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তির অন্ত থাকত না। অনেক সময় দেখা যেত, আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো কালকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। আবার একই দিনে ও একই সময়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা থাকত, যার ফলে শিক্ষার্থীরা ভর্তি ফরম ক্রয় করলেও কাঙ্ক্ষিত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারত না। পত্রপত্রিকা ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে তখন থেকে ভর্তি পরীক্ষার সংখ্যা কমানো বা বিকল্প উপায় সন্ধানের দাবি উঠতে থাকে। পরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে শিক্ষার্থীদের পক্ষে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরকম বাস্তবতায় সরকারের পক্ষ থেকে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি নেওয়ার চাপ বাড়তে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আগে থেকেই একক ভর্তি পরীক্ষা বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে এবং তা বর্তমানে চলমান রয়েছে। গত দুই শিক্ষাবর্ষ ধরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আসছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা শুরু করে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে, যা জিএসটি (ঝেঞ) নামে পরিচিত।
জিএসটি ভর্তি পরীক্ষার প্রথম বছর থেকেই অভিজ্ঞতার অভাব ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুচ্ছ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। তাছাড়া ভর্তি প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কিছু আসন ফাঁকা থেকে যায় বলে অভিযোগ। দ্বিতীয় বারের ভর্তি পরীক্ষায়ও নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। যেমন ভর্তিচ্ছুদের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দুই মাসেরও অধিক সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের করণীয় সম্পর্কে অন্ধকারে থাকে। ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষার্থী গুচ্ছের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু করে দেয়। দেরিতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার কারণ হিসেবে জিএসটির পক্ষ থেকে বলা হয় যে সমন্বিত ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য সফটওয়ার তৈরি করতে তাদের এই সময় লেগেছে। সময়ক্ষেপণের কারণে ভর্তির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জিএসটিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যখন ক্লাস শুরু হয়, তখন জিএসটির বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার-পাঁচ মাস ক্লাস ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মনে করেন, প্রথমবারের ভর্তি পরীক্ষার সময় যে সমস্যাগুলো উদ্ভূত হয়েছিল, সেগুলো সমাধানে পরবর্তীকালে কোনো বিষদ পর্যালোচনা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পরে দুই মাসের অধিক সময় শিক্ষার্থীরা অন্ধকারে থাকায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী সেশন জটের আশঙ্কায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায়, যে কারণে শিক্ষকেরা মনে করেন গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় আয়-ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে কোনো স্পষ্ট ধারণা না থাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অধিকন্তু নিজস্ব প্রক্রিয়ায় ভর্তি পরীক্ষা নিলে সেখানে অধিকসংখ্যক শিক্ষকের মধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে, যা গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় অনেক কমে যায়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে জিএসটির অধীনে সম্পন্ন ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। কিন্তু এই সমস্যাসমূহ সমাধানযোগ্য। বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ কম। কেননা, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০-এর অধিক। তবে গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত সমস্যাসমূহ আপাতত সমাধান করা গেলেও আমরা মনে করি গুচ্ছ প্রক্রিয়া কোনো চূড়ান্ত সমাধান দিতে পারবে না। কারণ গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে একটি চাপা ক্ষোভ রয়েছে। গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া চলমান থাকলে সব বিশ্ববিদ্যালয় পালাক্রমে এর নেতৃত্ব দিতে চাইবে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর ও সামর্থ্য এক নয়। বিশেষ করে ছোট আকারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে গুচ্ছের মতো একটি বড় ভর্তি পরীক্ষার নেতৃত্ব দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। আবার একটি বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর ভর্তি পরীক্ষার নেতৃত্ব দিলে তা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করবে, যার ফলাফল হিসেবে গুচ্ছবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধবে এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে এই প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
উপরোক্ত সমস্যাসমূহের একটি টেকসই সমাধান হতে পারে জাতীয় ভর্তি পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ বা ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (ঘঞঅ)। এনটিএ একটি পরীক্ষার পরিবর্তে বিষয়ভিত্তিক আলাদা আলাদা পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে, যেমন—পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, গণিত, বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান ও আনালাইটিক্যাল অ্যাবিলিটি। শিক্ষার্থীরা তাদের লক্ষ্য ও পছন্দ অনুযায়ী বিষয়সমূহের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবে। প্রশ্ন পদ্ধতি এমন হবে, যাতে মেডিক্যাল, প্রকৌশল, সাধারণ ও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের শর্ত ও প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ পায়। ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ শিক্ষার্থীদের ডাটা বেইজ এনটিএ অনলাইনে সংরক্ষণ করবে এবং শিক্ষার্থীদের নম্বরপত্রের সনদ দেবে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের নিজ নিজ শর্ত অনুযায়ী ছাত্রদের থেকে ভর্তির জন্য আবেদন আহ্বান করবে। এনটিএর পরীক্ষাসমূহ এইচএসসি পরীক্ষা সমাপ্ত হওয়ার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চতুর্থ সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করবে, যার ফলে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে। এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের এক মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের ছাত্র ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। এর ফলে সেশনজট কিছুটা কমে আসবে। প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়িত হলে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে চলমান বিতর্কের অবসান হবে বলে মনে করি।