আজ ২৯ মে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস । তিন দশকেরও বেশি সময় আগে থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনীর ৬ হাজার ৮০২ জন সদস্য শান্তি বজায় রাখার জন্য বিশ্ব জুড়ে ৯টি মিশনে কাজ করছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হলো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মোতায়েনে সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী জাতি হিসেবে তার শীর্ষস্থান বজায় রাখা।
সংঘাত ও যুদ্ধ কখনই কোনো জাতির জন্য উপকারী হতে পারে না। শান্তি বজায় রাখতে হলে যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধ করতে হবে। বিশ্বের যে সব অঞ্চলে সংঘাত রয়েছে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের যুদ্ধবিগ্রহ তদারকি সংস্থা (UNTSO) জাতিসংঘের প্রথম শান্তিরক্ষা বাহিনী। ২০০৯ সালে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় নারীদের অবদান ও ভূমিকার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা বাহিনী (১৯৮৮-২০২৩) জাতিসংঘের অধীনে ৩৫ বছর ধরে কাজ করছে। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় একটি মেডিক্যাল মিশন পাঠান শান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে। জাতিসংঘ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউএনআইএমওজি) মিশন প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ অপারেশনে ১৫ জন সামরিক পর্যবেক্ষক পাঠায়। ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা, সোমালিয়া এবং বসনিয়ায় সর্বাধিক আলোচিত শান্তি মিশনে নিজেদের শক্তি ও সক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড গ্রুপ ১৯৯৪ সালের গণহত্যার সময় রুয়ান্ডায় অবস্থান করে। প্রায় ১০০ দিনের গৃহযুদ্ধে প্রায় ৮ লাখ মানুষ মারা যায়। সেই মিশনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে বেলজিয়ানসহ আফ্রো-ইউরোপীয় ব্যাটালিয়নগুলো দ্রুত চলে যায় এবং তাদের অপারেশন স্থগিত করে। কিন্তু বাংলাদেশি সৈন্যরা বীরত্বের সঙ্গে মিশন অঞ্চলে থেকে যায়। ফলে গণহত্যায় মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। বাংলাদেশি সৈন্যদের সাহসিকতা ও দক্ষতা দেখে সবাই বিস্মিত হয়। মার্কিন সেনারা সোমালিয়া থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন প্রত্যাহার করার সময় তাদের শেষ কর্মী সোমালিয়া ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশি সেনাদের তাদের সঙ্গে থাকতে বলেছিল।
জাতিসংঘের অভিযানে বাংলাদেশি সৈন্যদের সবচেয়ে বড় সম্পদ স্থানীয় জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। প্রতিটি মিশনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের দক্ষতা দেখে জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষ মুগ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের শৃঙ্খলা, সততা, অধ্যবসায় এবং সামরিক দক্ষতা তাদের যে কোনো সামরিক কমান্ডারের জন্য অপরিহার্য করে তুলেছে। ১৯৯৫ সালে ফরাসি শান্তিরক্ষা ব্যাটালিয়ন বসনিয়া ত্যাগ করলে বাংলাদেশি সৈন্যরা তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন ৩৪টি বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তাদের শক্তি প্রদর্শন করেছে। বসনিয়ার দুটি শহর ‘সাব্রানিকা’ এবং ‘জাপা’ নামে পরিচিত। কঙ্গো, মালি, সুদান, দক্ষিণ সুদান, সাহারা, লেবানন, হাইতি এবং পূর্ব তিমুরের মতো জায়গায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনার জন্য বাংলাদেশের একটা সুনাম রয়েছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বৃহত্তর কল্যাণে তাদের জীবনকে বিপদে ফেলে ৪০টি ভিন্ন দেশে জাতিসংঘের ৫৫টি শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মিশন এলাকায় সক্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিরস্ত্রীকরণ, ল্যান্ডমাইন পরিষ্কার, নির্বাচনে সহায়তা, শিক্ষায় সহায়তা এবং সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক শান্তি সমুন্নত রাখতে গত ৩৪ বছরে এ দেশের ১৬১ জন শান্তিরক্ষী জীবন দিয়েছেন।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’। কারণ আমরা এমন একটি দেশ যারা শান্তিকে মূল্য দেয়। সিয়েরা লিওন বাংলাকে তাদের জাতির অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ তারা বাংলাদেশি সৈন্যদের গুরুত্ব স্বীকার করেছে। অনেক দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের এখন বীর হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মোতায়েনের মাধ্যমে জাতির জন্য ২ হাজার কোটিরও বেশি টাকা রেমিট্যান্স এনেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে শান্তি এনে দিয়ে সেসব জাতির জনগণের সম্মান অর্জন করছে। জাতিসংঘের কার্যক্রম এবং বহুজাতিক বাহিনীর প্রতি স্বতন্ত্র অঙ্গীকারের কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত হয়েছে।