যুদ্ধ মানবজাতির জন্য কখনো কল্যাণ বয়ে আনে না। যুদ্ধের ধর্মই হলো বিনাশ করা। যুদ্ধে জড়িয়ে এক পক্ষ জয়লাভ করলেও অন্যপক্ষকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। কেউ কেউ যুদ্ধে অংশ নেয় নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে। আবার কেউ কেউ যুদ্ধে অংশ নেয় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সিংহাসন আরো পাকাপোক্ত করতে। এতে একপক্ষ লাভবান এবং অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভক্ষতির হিসাব শুধু দুই পক্ষের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে না। বরং বিশ্বের প্রতিটি দেশই কিছু না কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে মানবিক পৃথিবী আরো অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সত্যি বলতে, যুদ্ধ-সংঘাতের মাধ্যমে পৃথিবীকে হুমকির মুখে রেখে নিজেদের ক্ষমতার প্রসার ঘটানোর চিন্তাভাবনা লালন করলে পুরো বিশ্বসভ্যতা শত শত বছর পিছিয়ে যায়। কারণ এগিয়ে যেতে হলে সবাইকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। একজনকে বসিয়ে রেখে আরেক জন এগিয়ে গেলে অসামঞ্জস্য এক পৃথিবী তৈরি হয়। পদে পদে বিভাজন সৃষ্টি হয়। এসবের ফলে মানবিক পৃথিবী গড়ার আসল উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হয়।
কালক্রমে কোনো উন্নত দেশ যদি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে যুদ্ধ শেষে তাদেরও ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগে। দেশ যত উন্নত হোক না কেন, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কারণে সবার অবস্থাই শোচনীয় হয়ে পড়ে। আমরা দেখেছি, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবীতে যে দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল, তা পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে ভুগিয়েছিল। কত মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছে তার হিসাব নেই! প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একটি বা দুইটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আস্তে আস্তে পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করেছিল। এই যে এত যুদ্ধ, এত শক্তি বা ক্ষমতা লাভের লালসা পৃথিবীকে কি শান্তি দিতে পেরেছে? পারেনি। যুদ্ধ কখনো কোনো সমাধানের পথ হতে পারে না। যুদ্ধ ছাড়াও সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাতে উভয় পক্ষের সমর্থন এবং ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।
ইতিহাসের পাতা থেকে চোখ নামিয়ে বর্তমান বিশ্বের কথা চিন্তা করলেই কপালের ভাঁজ আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গত বছর থেকে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাদেরকে এক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করছে। পৃথিবীর কেউ আজ ভালো নেই। শুধু ছোট অর্থনীতির দেশগুলো নয়, ধনী দেশগুলোও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে সময় পার করছে। বিশ্ববাজারে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া, মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া, জিনিসপত্রের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া—সবকিছুই চলছে সমান তালে। জীবনযাত্রার মান এতটাই কঠিন হয়ে গেছে যে, সবকিছু সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ এই আধুনিক সময়ে এসে মানুষের জীবন সহজ হওয়ার কথা ছিল! কেউ না চাইলেও তাদের এই দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ফল ভোগ করতে হচ্ছে! বিশ্বে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবীব্যাপী যে দুর্ভিক্ষ তৈরি হবে, তা সামাল দেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সব পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তির রাস্তায় হাঁটতে হবে।