আমাজন একটি রহস্যময় জঙ্গল। এই জঙ্গলের জীববৈচিত্র্য ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময়। রয়েছে হরেক জীববৈচিত্র্য এবং হাজার হাজার প্রজাতির প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন গাছগাছালির সমাহার, যা থেকে সমগ্র বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের চাহিদা মিটছে। বিশ্ববাসীর কাছে এই জঙ্গলের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে, তাই আমাজনকে বলা হয় ‘বিশ্বের ফুসফুস’। আমাজন জঙ্গলে বজ্রপাত অথবা দাবানলের কারণে যতটা না ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তার চেয়ে বহুগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নাশকতার ঘটনায়। ফলে আমাজান থেকে বছরে ২২৮ মেগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল নির্গত হয়। অর্থাৎ একদিকে বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে ওজোনস্তর রক্ষা করছে আমাজন, অন্যদিকে কার্বন নিঃসারণ হয় আগুন লাগানোর কারণে। যার জন্য অধিকাংশই দায়ী হচ্ছে স্থানীয় জনসাধারণ। বিশেষ করে আমাজনে আগুন লাগানোর জন্য বেশির ভাগই দায়ী হচ্ছে ব্রাজিল।
আমাজন জঙ্গলের ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে ৬০ শতাংশ পড়েছে ব্রাজিল সীমানায়, যা সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে দেশটি। সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে, ব্রাজিলের এনজিও সংস্থার লোকেরা এ ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত; যেখানে দেশটির সরকারের স্বার্থও জড়িত রয়েছে বলে জানা যায়। ব্রাজিল সরকার তাই সব সময় বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দাবানলের কারণেই জঙ্গল পুড়ছে। আবার বলা হচ্ছে, কৃষকেরা আগুন লাগিয়েছেন চাষাবাদের জন্য। ব্রাজিল এনজিওদের বিষয়টি সম্পূর্ণ চেপে যাচ্ছে। তবে বিশ্ব গণমাধ্যম সোচ্চার থাকায় ব্রাজিলের সেই অপচেষ্টা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে বারবার।
এবার আমরা একটু নজর দেব বিগত কয়েক বছরের অগ্নিকাণ্ডের দিকে। সর্বশেষ বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ২০২০ সালের আগস্ট মাসে। পরিবেশবাদী সংস্থা ‘গ্রিনপিস’ জানিয়েছে, ঐ সময় প্রথম ১০ দিনে ১০ হাজার ১৩৬টি জায়গায় আগুন জ্বলতে দেখা গিয়েছিল। ২০১৯ সালের তুলনায় এই অগ্নিকাণ্ড ১৭ শতাংশ বেশি ছিল। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিনই কমবেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে আমাজন জঙ্গলে, যা অনেক সময় জরিপে আসে না অথবা গণমাধ্যমে প্রচারও হয় না। তবে দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা যতগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাজনে ঘটেছে, তার সবগুলোর নেপথ্যের কারণ অস্বীকার করছে ব্রাজিল সরকার। ২০১৯ সালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে ব্রাজিল সরকারের মিথ্যাচারের চিত্রও তুলে ধরেছিল বিবিসি।
বিশ্বের অন্যান্য গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিবিসি বাংলা ২৭ আগস্ট, ২০১৯ সালের এক গবেষণার উদ্ধৃত দিয়েছে, ‘বন উজাড় করা আর দাবানলের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলে ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলের খরা থেকে আগুনের সূত্রপাতের তত্ত্বটিকে আবার ভুল হিসেবে ধরে নিতে হবে।
গবেষণায় আরো উঠে এসেছে, শুষ্ক মৌসুমে এরকম ব্যাপকভাবে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে খরার সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা সামান্যই, যেখানে অন্যান্য বারের চেয়ে ২০১৯ সালের খরার তীব্রতা কমও। গবেষণায় আরো উদ্ধৃত করা হয়েছে, ‘সবচেয়ে বেশি পরিমাণ আগুনের ঘটনা যে ১০টি মিউনিসিপ্যালিটিতে ঘটেছে, সেখানেই সবচেয়ে বেশি মাত্রায় বন উজাড় করা হয়েছে। ২০১৯ সালের আগুনের ৩৭ শতাংশ ঘটেছে এই ১০টি স্থান থেকে, আর ঐ বছরের জুলাই পর্যন্ত মোট উজাড় করা বনের ৪৩ শতাংশ ঘটেছে এসব এলাকায়। নতুন করে বৃক্ষহীন হওয়া এবং কিছুটা খরায় ভুগতে থাকা এলাকায় দাবানলের ব্যাপকতা আগুনের চরিত্রের একটি বিষয়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। সেটা হলো কোনো এলাকা বৃক্ষহীন করে ফেললে সেটা নতুন ঐ এলাকাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করে।’ গবেষকেরা তিনটি আলাদা সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে এই গবেষণা পরিচালনা করেছেন।
২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসের বন উজাড় করার তথ্য এবং বছরের শুরু থেকে আগস্টের ১৪ তারিখ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া দাবানলগুলোর তথ্য আমলে নেওয়া হয়েছে গবেষণাটিতে।
গবেষণায় দাবি করা হয়, ‘আমাজনে যে পরিমাণ আগুনের ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু শুষ্ক মৌসুমের কারণে নয়। অধিকাংশ রাজ্যেই আগুনের ঘটনা গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ঘটেছে, যার সংখ্যা ৩২ হাজার ৭২৮, যা একই সময়ে গত তিন বছরের গড়ের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি।’ অন্যদিকে ২০২১ সালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ১৯ শতাংশের কাছাকাছি, যার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ২০২২ সালের জুন মাস অবধি আমাজনের বনভূমি ধ্বংসের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে সুখবর হচ্ছে, আমাজনের দাবানল নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠলে, বিশেষ করে ব্রাজিলকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিলে দেশটির টনক নড়ে এবং বন রক্ষা চুক্তিতে সই করতে দক্ষিণ আমেরিকার সাতটি দেশ সম্মত হয়। চাপে পড়ে আমাজন নদী অববাহিকা রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে ব্রাজিল, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, পেরু, সুরিনাম ও গায়ানা। চুক্তিতে দুর্যোগ মোকাবিলা নেটওয়ার্ক ও স্যাটেলাইট নজরদারির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ভালো একটি উদ্যোগ বলা যায়। এর ফলে হয়তো ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আমরা আমাজন অববাহিকায় বড় ধরনের তেমন কোনো নাশকতার সংবাদ শুনতে পাইনি, যা বিশ্ববাসীর জন্য মস্ত সুখবর বলা যায়। সেই বিশ্বাস নিয়ে আমরা বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহব্বান জানাচ্ছি স্যাটেলাইট নজরদারি জোরদার করার। তাতে আমাজনের নয়া ক্ষত সৃষ্টি হবে না আর, সেই সুযোগে ধীরে ধীরে পুরোনো ক্ষত শুকিয়ে আসবে।