কেবল যুদ্ধাপরাধই নয়, নিঃসন্দেহে ধ্বংসের এক মহাকাব্য রচনা করে চলেছে রাশিয়া। এই মহাকাব্যের প্রতিটি ভয়াবহ অধ্যায়ের সাক্ষী বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ। বিগত কয়েক দিনে রাশিয়ান বাহিনীর নারকীয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযোগকারী কার্চ ব্রিজে সংঘটিত বিশাল বিস্ফোরণের পর নড়েচড়ে বসেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিনের আবেগের এই সেতুতে হামলার ঠিক ৪৮ ঘণ্টা না পেরোতেই ইউক্রেন জুড়ে বেসামরিক জনগণের ওপর শুরু হয় নির্বিচার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। বৃষ্টির মতো গোলাবারুদ পড়তে থাকে ইউক্রেনে। দেশটির দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত জাপোরিঝিয়ার একটি ৯তলা টাওয়ারকে গুঁড়িয়ে দেয় রাশিয়ান রকেট। রকেট লাঞ্চার ছুড়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয় বহু আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন।
হামলা থেকে বাঁচতে জাপোরিঝিয়ার বাসিন্দা ক্যাটেরিনা ইভানোভা তার পরিবার নিয়ে বাথরুমে লুকাতে বাধ্য হন। তাদের অ্যাপার্টমেন্ট আচ্ছন্ন করে ফেলে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ক্যাটেরিনা দৌড়ে রাস্তায় আসতে সক্ষম হন বটে, তবে ভবনে আটকে পড়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলে শোনা গেছে। পালানোর সময় এক প্রতিবেশীকে ‘স্বামী মারা গেছে’ বলে চিত্কার করে প্রলাপ করতে দেখেছেন ক্যাটেরিনা। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বাড়ির দরজা উড়ে গেলে সন্তান-সন্ততিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে নিরাপদ স্থানের দিকে দৌড় দিয়েছিলেন বলে জানান লুডমিলা নামের আরেক বাসিন্দা। প্রাণে বেঁচে গিয়ে ক্যাটেরিনা ও লুডমিলা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছেন যদিও; কিন্তু এই ভয়াবহ হামলায় লাশে পরিণত হন অনেক বেসামরিক ইউক্রেনীয়। ক্ষয়ক্ষতিও নেহাত কম নয়। পশ্চিমে লভিভ এবং পূর্বে খারকিভ অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছে বহু নিরীহ বেসামরিক নাগরিক। মধ্য কিয়েভের শেভচেংকো পার্কে শিশুদের খেলার মাঠও রক্ষা পায়নি রাশিয়ান বাহিনীর হামলা থেকে। শিশুদের বিচরণস্থলে গুলি ছুড়তেও দ্বিধা করেনি পুতিন বাহিনী। ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরণের ফলে মাটিতে সৃষ্টি হয় বড় বড় গর্ত। সত্যি বলতে, সামরিক-বেসামরিক কোনো স্থাপনাতেই হামলা চালাতে দুই বারও ভাবছে না আগ্রাসী রাশিয়ান বাহিনী।
বাস্তবিক অর্থেই প্রতিদিন যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটছে ইউক্রেনে। এরূপ অবস্থায় ইউক্রেনের মিত্রদের অবশ্যই সম্মিলিত আওয়াজ তুলে নিশ্চিত করতে হবে যে, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের এই গুরুতর লঙ্ঘন যেন গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়, শাস্তির বাইরে না যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ান বাহিনীর ইউক্রেনে অবৈধ আগ্রাসনের পর বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলো একত্রিত হয়ে রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতিকে মারাত্মক সংকটের মুখে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে সত্য; কিন্তু মনে রাখতে হবে, এর প্রভাবে ততটা মুখ থুবড়ে পড়েনি রাশিয়া, যতটা প্রত্যাশিত ছিল। কাজেই রাশিয়া ও পুতিনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক ব্যবস্থা যদি এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তবে বলতে হয়, এই ব্যবস্থা ততটা পর্যাপ্ত নয়। আরো কিছু করাটা অবধারিত হয়ে উঠছে দিনকে দিন। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, আমাদের উচিত হবে রাশিয়াকে এখন পূর্ণ মাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এবং ইউক্রেনের প্রতি সামরিক সহায়তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় জোরদার করে পুতিনকে পরাজিত করা অথবা সামনের দিনগুলোতে রাশিয়ান বাহিনীকে পরাজয় বরণে বাধ্য করতে বৃহত্তর যুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখা। আজকের বিশ্বে অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য এটি করা অনেক বেশি মূল্যবান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়ান বাহিনীর নির্বিচার হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসে অর্থায়নের বিষয়ে নজরদারি করা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এফএটিএফ সদস্য এবং আন্তর্জাতিক মদ্রা তহবিল, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, ইন্টারপোল এবং এগমন্ট গ্রুপ অব ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর প্রতি ইতিমধ্যে আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ‘রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মানবাধিকারকে পাইকারিভাবে লঙ্ঘন করে চলেছে বিধায় বিভিন্ন সংস্থা থেকে দেশটিকে বাদ দেওয়া উচিত।’ বাস্তবিক অর্থেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তা হবে বাস্তবসম্মত এবং এর ফলে অযাচিত যুদ্ধ বন্ধ করার প্রশ্নে ক্রেমলিনের ওপর চাপ বাড়বে। উপরন্তু, এফএটিএফ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এই সংকেত যাবে যে, নিজেদের অর্থনৈতিক তহবিল সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে রাশিয়াকে যেন কোনোভাবেই নির্ভরযোগ্য আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। এভাবে রাশিয়াকে কালো তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে দেশটির নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর ক্ষমতা সীমিত করা আরো সহজতর হবে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, পরিস্থিতি সামলাতে রাশিয়ান বিভিন্ন কোম্পানি দেশীয় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে একটি ‘লেনদেন কাঠামো’ গড়ে তুলেছে, যার কোনো নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই। এই অবস্থায় একবার যদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে রাশিয়া বাদ পড়ে যায়, তবে দেশটির গড়ে তোলা এই বিকল্প ব্যবস্থাও মুখ থুবড়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির অর্থ লেনদেন কঠিন হয়ে উঠবে এবং এর দরুন বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে ব্যাপকভাবে। অর্থাৎ, অনিবার্যভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে যাবেন পুতিন। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে ইরান এফএটিএফের কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পর দেশটির পণ্য ও পরিষেবা রপ্তানি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে।
আমরা এফএটিএফকে নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করতে বলছি না। আমরা দেখেছি, ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য দোষী চিহ্নিত করে ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ’সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়াকে বহিষ্কার করেছে। রাশিয়ার জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। মাথায় রাখতে হবে, আগ্রাসন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার মতো যেসব জঘন্য অপরাধ করে চলেছে রাশিয়ান ফেডারেশন, তাতে অর্থায়ন করা হচ্ছে খোদ দেশটির রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে দৈনিক ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করছে রাশিয়া, এই টাকার পুরোটাই আসছে রাশিয়ার সাধারণ জনগণের পকেট থেকে।
এমতাবস্থায়, যেহেতু আন্তর্জাতিক আর্থিক অপরাধ মোকাবিলায় এফএটিএফ কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, রাশিয়ার আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘনের বিষয়ে সংস্থাটির কড়া ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এর ফলে বিশ্বব্যাপী এফএটিএফের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা আরো বেশি পোক্ত হবে—এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ইস্যুতে ঠিকঠাক অবদান, প্রভাব রাখতে না পারার কারণে অনেক সমালোচিত হলেও ‘ইউক্রেন যুদ্ধ’ ইস্যুতে নড়েচড়ে বসে সংস্থাটি। ইউক্রেনের চারটি প্রদেশকে—খেরসন, জাপোরিঝিয়া, দোনেত্স্ক ও লুহানস্ক রাশিয়ার ‘অবৈধ অধিভুক্তির প্রচেষ্টা’ সম্পর্কে সংস্থাটির নিন্দা প্রস্তাবে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো অপ্রতিরোধ্যভাবে ভোট দিয়ে নজির স্থাপন করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে সংস্থাটির তরফ থেকে ঘোষণা এসেছে—মস্কোর আঞ্চলিক দাবিগুলোর ‘আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক কোনো বৈধতা নেই।’
মনে রাখতে হবে, ১৪৩টি দেশ ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছে। সুতরাং অতিসত্বর এফএটিএফকে এই সত্য মাথায় ঢোকাতে হবে যে, ‘রাশিয়ান নেতৃত্ব কেবল বোঝে ‘শক্তি’—শক্তিমত্তার মিথ্যা অহমিকাই রাশিয়ার একমাত্র অবলম্বন।’ সন্দেহাতীতভাবে এটা এখন স্পষ্ট যে, রাশিয়ার অবৈধ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যত বেশি আক্রমণাত্মক ও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো যাবে, এই যুদ্ধ তত দ্রুত শেষ হবে। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে বাধ্য হবে রাশিয়া। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে পুতিনকে শান্তির পথে হাঁটতে ক্রমবর্ধমানভাবে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন জেলেনস্কি। এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের পরিষ্কার বার্তা হলো, ‘ইউক্রেন শান্তি চায় এবং পুতিন বাহিনীর জবরদস্তির কাছে কখনো নতি স্বীকারও করবে না ইউক্রেনের জনগণ।’
কার্চ ব্রিজে বিস্ফোরণের পর পুতিন বাহিনী এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে যে, তাদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি ইউক্রেনের জাতীয় কবি তারাস শেভচেংকোর নামে নামকরণ করা স্থাপনাও। স্মরণে রাখতে হবে, তারাস শেভচেংকোর ছিলেন সেই প্রতিবাদী ভূমিদাস, যিনি ১৯ শতকে জারবাদী রাশিয়ান শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
ইউক্রেনকে করায়ত্ত করার মানসে পুতিন রক্তের যে হলিখেলা শুরু করেছেন, তার প্রতিবাদে ইউক্রেনীয়রা এক জায়গায় জড়ো হয়ে সমস্বরে গেয়ে চলেছেন কবি শেভচেংকোর প্রতিরোধ-সংগীত। গোটা ইউক্রেনে ভবনগুলোর দেওয়ালের লাইটিংয়ে আলোড়ন তুলছে নানা প্রতিরোধ স্লোগান। ইউক্রেনীয়দের লক্ষ্য একটাই—স্বৈরশাসকের কাছে মাথা নত না করা।
লেখক :স্যাংশন এক্সপার্ট ও ইউক্রেনের প্রেসিডেনশিয়াল অফিসের কর্মকর্তা
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ :সুমৃৎ খান সুজন