সোমবার রাত থেকে বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি শুরু হয়। নতুন করে বন্যার আশঙ্কায় দুর্গতরা।
কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট ছাড়া সিলেটসহ বেশির ভাগ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। চলছে মানুষের দুর্ভোগ। রাস্তাঘাট ভেঙে বেহাল। বাড়িঘরে ফিরে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছে মানুষ। এখনো পানিতে তলিয়ে থাকা এলাকায় যাতায়াতের কষ্টে রয়েছে মানুষ। সেই সঙ্গে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ।
কোম্পানীগঞ্জে গতকাল মঙ্গলবার ভোর থেকে সারা দিনে বিভিন্ন এলাকায় দেড় ফুটের মতো পানি বাড়ার খবর মিলেছে। গোয়াইনঘাট উপজেলায়ও পানি কিছুটা বেড়েছে। তবে বাকি উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। কিছু উপজেলায় পানি কিছুটা কমেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি বিপত্সীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া অমলসিদে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপত্সীমার ১৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, শেওলায় কুশিয়ারা নদীর পানি বিপত্সীমার ৪৫ সেন্টিমিটার এবং ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপত্সীমার ১০৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সোমবার রাত থেকে বৃষ্টিপাত হওয়ায় গতকাল সকাল থেকেই বন্যার পানি বাড়তে থাকে। উপজেলার ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের লম্বাকান্দি গ্রামের আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে সকাল থেকে পানি বাড়ছিল। বিকেল পর্যন্ত দেড় ফুটের মতো পানি বেড়েছে। ’ লাছুখালী গ্রামের আমেনা খাতুন বলেন, ‘বাড়ি ছাড়ার ১১ দিন পর বাড়ি ফিরে শান্তি নাই। ঘরদোর এই দুই দিনে ঠিকঠাক করেছি। আবার পানি বাড়ছে। আবার ঘরে ঢোকে কি না কে জানে। ’
সুনামগঞ্জে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি ১৪ সেন্টিমিটার বেড়েছে। তবে এখনো বিপত্সীমার ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে একই নদীর পানি ছাতক পয়েন্টে এখনো বিপত্সীমার ৬০ সেন্টিসিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীতে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্গতরা আতঙ্কে রয়েছে। তবে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যার উন্নতির পূর্বাভাস দিয়েছে। মেঘালয়ে বৃষ্টিপাত হলে পানি বাড়ার আশঙ্কার কথাও জানিয়েছে তারা।
জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এখনো ২৯৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫১ হাজারের বেশি বানভাসি অবস্থান করছে। সরকার বানভাসিদের মধ্যে এক হাজার ৩৫৬ মেট্রিক টন জিআরের চাল, দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা ও ২৩ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করেছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৯৭ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি আছে ১৮৩ জন। এ ছাড়া বাড়িতে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে অবস্থান করছে অসংখ্য মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে বন্যাকবলিত ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বাসিন্দারা। জেলা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে ৬৮ জন। অন্যান্য সময়ে এত ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগী থাকে না বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লালপুর গ্রামের হোসেন আলী বলেন, পানি কমতে শুরু করলেও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। তবে মানুষ ত্রাণ হিসেবে স্যালাইন পাওয়ায় অনেকেই হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতেই এসব রোগের চিকিৎসা নিচ্ছে। এ ছাড়া হঠাৎ চর্মরোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আহম্মদ হোসেন বলেন, অন্য সময়ের তুলনায় এখন বন্যা-পরবর্তী ডায়রিয়া ও চর্মরোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে অনেকেই। তবে ত্রাণের স্যালাইন পাওয়ায় অনেকে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছে। যাদের অবস্থা খারাপ, তারাই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যারা হাসপাতালে আসতে পারছে না, আমাদের ১২৩টি মেডিক্যাল টিম তাদের বাড়িতে গিয়েও চিকিৎসা দিচ্ছে। ’
কুড়িগ্রাম পাউবোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় ধরলায় পানি বেড়েছে ৩৩ সেন্টিমিটার। তিস্তার পানিও বাড়ছে ধীরগতিতে। পাউবোর প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টা পানি বাড়তে থাকবে। তবে বিপত্সীমা অতিক্রম করবে কি না, তা বলা যাচ্ছে না।
এদিকে ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধিতে ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম সদর ও উলিপুর উপজেলার অন্তত ৩০টি চর ও নদীসংলগ্ন গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ। এসব এলাকার পাট, ভুট্টা, বীজতলা ও সবজি ডুবে গেছে। সড়কে পানি ওঠায় চলাচল করতে পারছে না মানুষ। ভেলা ও নৌকায় চলাচল করতে হচ্ছে।
রাজারহাট উপজেলার নামা জয়কুমর গ্রামের কৃষক এরশাদুল হক জানান, প্রথম দফা বন্যায় বীজতলা নষ্ট হওয়ার পর নতুন করে বীজতলা তৈরি করে আমনের বীজ বপন করেছিলেন। পানি বৃদ্ধির ফলে সেই বীজতলাও ডুবে গেছে।
দুই সপ্তাহের বন্যায় পানির কারণে দেখা দিয়েছে হাতে-পায়ে ঘা, ডায়রিয়া ও আমাশয়সহ নানা পানিবাহিত রোগ। বন্যায় সংকট দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের। বেড়ে গেছে দামও। মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুও আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগে।
মৌলভীবাজার সদর ছাড়াও কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও রাজনগর উপজেলায় দুর্গত মানুষ ব্যাপক ভোগান্তি পোহাচ্ছে। গতকাল সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানানো হয়, জেলায় এ পর্যন্ত পানিবাহিত রোগসহ নানা রোগে ৮৬৭ জন আক্রান্ত হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাকালুকি হাওরসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি এবং কিছু এলাকার নিম্নাঞ্চলের পানি কমতে শুরু করেছে। তবে বেশ কিছু এলাকায় এখনো বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। ঘরবাড়িতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পানিতে ডুবে থাকায় বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ আশ্রয়কেন্দ্রেরও একই অবস্থা। দূর-দূরান্ত থেকে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহ করে পান করছে তারা। পানি মাড়িয়ে যাওয়া-আসা করায় নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবাহিত রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, কাশি, আমাশয়, চর্মরোগ, পেট ব্যথা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গাদাগাদি করে থাকায় চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
সিভিল সার্জন চৌধুরী জালাল উদ্দীন মোর্শেদ জানান, বন্যাকবলিত এলাকায় ৭৪টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, মৌলভীবাজারে ৫৮ হাজার ৬৯১টি পরিবারের দুই লাখ ৬৩ হাজার ৪০০ সদস্য ক্ষতির মুখে। ১৪ হাজার ২০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে ৮৮ হাজার।
শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। জেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ভোগাই, চেল্লাখালী, মহারশি, সোমেশ্বরীসহ সব নদ-নদীর পানি বিপত্সীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ঝিনাইগাতী, হাতিবান্ধা, মালিঝিকান্দা, নালিতাবাড়ীর মরিচপুরান, যোগানিয়া, কলসপাড়, সদরের গাজীরখামার এবং নকলার উরফা ও নকলা ইউনিয়নের বেশ কিছু নিম্নাঞ্চলে এখনো পানি রয়েছে। দুর্গত মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।