ব্যাংকে টাকা রাখলে বিপাকে পড়বে আমানতকারীরা অথবা টাকা নেই ব্যাংকে এমন একটি বার্তা সম্প্রতি ব্যাংকপাড়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। অনেকেই ব্যাংকে আমানত সুরক্ষিত কি না, জানতে ব্যাংকের শাখাগুলোতে যোগাযোগ করছেন। দেশ-বিদেশ থেকে ব্যাংকারদের কাছে, ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকর্তা এমনকি গভর্নরসহ বিভিন্ন পর্যায়ে টেলিফোন আসছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকে অর্থের কোনো সংকট নেই। বর্তমানে ব্যাংক খাতে প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়নি। তাই আতঙ্কের কিছু নেই।
এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নানা কথাবার্তা বলা হচ্ছে। কেউ বলছে, ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। টাকা দিতে পারছে না। এসব কারণে ব্যাংক খাতে একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে ব্যাংকে আমানতকারীদের টাকা নিরাপদে আছে থাকবে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
এমন পরিস্থিতির কারণ কী? : অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংগুলোর কয়েক জন শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ব্যাংক খাতে ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি ব্যাংক বা নন-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন (এনবিএফআই) দুর্বল অবস্থায় আছে, সেটি সত্যি। চার থেকে পাঁচটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপ অবস্থায় আছে। আবার ১০টি ব্যাংক বেশি ভালো নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংকগুলো দেউলিয়ার মতো অবস্থায় নেই। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও অর্থনীতি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে। যে কারণে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে ব্যাংক খাতে ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবার অতীতের কিছু ঘটনা নিয়ে অনেক গ্রাহক বা আমানতকারী চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। যেমন স্বাধীনতার পরে এনসিসি ব্যাংক পুনর্গঠন করা হয়েছে। ইস্টার্ন ব্যাংক ও সর্বশেষ পদ্মা ব্যাংক নতুন ভাবে এসেছে। মাঝে দুই একটি ব্যাংকের সমস্যা যে হয়নি তা নয়। যেমন বেসিক ব্যাংকের সমস্যা হয়েছিল কিন্তু তাদের তারল্য সংকটে আমানতকারীদের আমানত দিতে পারেনি, এমনটি হয়নি। পদ্মা ব্যাংকের আমানত দিতে কিছু সমস্যা হয়েছিল। এখন আর সে অবস্থায় নেই। তবে ব্যাংক খাতে কিছু দুর্বলতা আছে সেসব কাটিয়ে উঠতে পারলে ব্যাংক খাতের আতঙ্ক নামের সংকট কেটে যাবে।
ব্যাংকাররা বলছেন, কিছু গ্রাহক টাকা পাচার করছে। আবার কিছু ব্যাংক এলসি খুলছে না, পেমেন্ট দিতে পারছে না। ডলার সংকট চলছে। ঋণখেলাপিরা বার বার সুযোগ নিচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে গ্রাহকের স্বস্তি আসবে। হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতি তৈরির পেছনে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানতের ঝুঁকি তখনি সৃষ্টি হয় যখন ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়। এ মুহূর্তে ব্যাংক বন্ধের কোনো কারণ নেই। তবে এ আতঙ্কের বড় কারণ হলো ডলার সংকট। বাণিজ্য ঘাটতি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া। বাড়ছে হুন্ডি, যার প্রভাব পড়ছে রিজার্ভের ওপর। ফলে প্রয়োজনীয় এলসি খোলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি ব্যাংকের বাইরে এলসি খোলার ডলার যোগান দিচ্ছে না। এসবের জন্য আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। এখানেই আমানতকারীদের মধ্যে ভুল বার্তা যাচ্ছে।
বেসরকারি ব্যাংকের একাধিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, চলতি বছরের শুরু থেকে গণমাধ্যমে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যোগদানের পরপর দুটো সংবাদ সম্মেলনে ১০টি ব্যাংক দুর্বল অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছেন। এটি গণমাধ্যমে ফলাওভাবে প্রচার হয়েছে। বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা রয়েছে। মানুষ সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলছেন। ব্যাংক থেকে আমানতে ভালো সুদ পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে গ্রাহকদের মনে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। অনেক ইউটিউবার অনলাইনে আর্থিক খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন, যাদের এ বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই। এসব বিভিন্ন কারণে গ্রাহকরা ব্যাংকে টাকা রাখবেন কি রাখবেন না ব্যাংকে ব্যাংকে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন।