বড় ধরনের অনিয়মের আশঙ্কায় ১৯৯৪ সালে প্রথম ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আরো কয়েকটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়। দেশে ব্যাংক রয়েছে ৬১টি। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ১৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক ও নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এই দায়িত্ব পালন করছেন। তার মানে দেশের এক-চতুর্থাংশ ব্যাংক এখন পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক দিয়ে চলছে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর উন্নয়নে এক বছর আগে সমন্বয়ক নিয়োগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে থেকে কিছু ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নতুন করে আরো কয়েকটিতে পর্যবেক্ষক বসানো হয়। এসব ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশে এখন এমন ব্যাংকের সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বেশির ভাগ ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংক নতুন করে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এসব ব্যাংকে দায়িত্ব পালন করা সমন্বয়ক ও পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে সভা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গভর্নরের সঙ্গে এটি ছিল তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা। বর্তমানে সমন্বয়ক আছেন সাত ব্যাংকে। এ ছাড়া পর্যবেক্ষক রয়েছেন আট ব্যাংকে। সভায় গভর্নর এসব ব্যাংককে বেঁধে দেওয়া লক্ষ্য অর্জনে তদারকি অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেয়েছেন বলে জানা গেছে। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন যাতে নিশ্চিত হয়, তা তদারকি করতে বলেছেন। এ ছাড়া যেসব ব্যাংকে কোনো উপায়ে অনিয়ম ঠেকানো যাচ্ছে না, সেগুলোর উন্নতিতে কৌশল নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন। পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়কদের সঙ্গে এটা প্রথম সভায় ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিতে আরো উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। এসব ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নয়নে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, তা যেন কোনোভাবে লক্ষ্যচ্যুত না হয়, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে গত বছরের ৪ আগস্ট আব্দুর রউফ তালুকদার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, চারটি চলকের ওপর ভিত্তি করে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে। চলকগুলো হচ্ছে শ্রেণীকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও প্রভিশনের পরিমাণ। চারটি চলকের ওপর ভিত্তি করে চিহ্নিত দুর্বল ব্যাংকগুলোর সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা আলাদা (ওয়ান-টু-ওয়ান) ভিত্তিতে আলোচনা শুরু করছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো তিন বছর মেয়াদি ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতিটি ব্যাংকের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবেন।
অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নিয়মের মধ্যে রাখা এবং গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতেই পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থিত থেকে সভায় ব্যাংকের স্বার্থ পরিপন্থি কিছু হলে তারা মতামত দেবেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি না, এ বিষয়ে তারা প্রতিবেদন দেবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক যতদিন মনে করবে ততদিন পর্যবেক্ষকেরা কাজ করবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ না করলেও কোন ব্যাংক কী করছে—সেটা দেখার ক্ষমতা ও দায়িত্ব তাদের। তারা তা দেখেনি। পর্যবেক্ষকও সঠিকভাবে কাজ না-ও করতে পারেন। তাকে ঠিকমত কাজ করতে দেওয়া না-ও হতে পারে। আমরা দেখেছি একজন পর্যবেক্ষক কাজ করতে না পেরে পদত্যাগ করে চলে গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক আরেক জন বসিয়ে দিয়েছে।
আসল কথা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংককে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। দায়িত্ব পালন করতে হবে। ছোটখাটো ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করলে হয়তো কাজ হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সরসরি মনিটর করতে পারে। কোনো অনিয়ম হলে তারা তা সরাসরি দেখতে পারে। আমরা এর আগেও তো দেখেছি পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে কাজ হয়নি। তারা কাজ করতে পারেননি। একটি ব্যাংকের প্রভাবশালী ১৫ জন পরিচালক আর ১০ কর্মকর্তার সামনে পর্যবেক্ষক কী করবেন। অনেক পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক সভায় অংশ নিয়ে সম্মানি নিলেও কোনো ভূমিকা রাখছেন না। সভাগুলোতে যেসব অনিয়ম হচ্ছে, তা-ও তুলে ধরছেন না। এমনকি সভা শেষে কেউ কেউ প্রতিবেদনও জমা দিচ্ছেন না। ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আরো কয়েকটি ব্যাংক দুর্বল হওয়ার তথ্য পরিদর্শনে ধরা পড়ছে। আগে যেসব ব্যাংকে পর্যবেক্ষক দেওয়া হয়েছে, সেগুলোরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। ফলে এই মডেল ব্যর্থ হলে পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক বসানো ছাড়া উপায় থাকবে না।