একই রাতে ভাগ্য পরীক্ষায় মাঠে নামছে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। অর্থাৎ আজ রাতে চলমান কাতার বিশ্বকাপের প্রথম দুই কোয়ার্টার ফাইনাল খেলবে কিংবদন্তি পেলে ও দিয়াগো ম্যারাডোনার দেশ। বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় শেষ আটের প্রথম ম্যাচে রেকর্ড সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলবে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া। ম্যাচটি হবে কাতারের রাজধানী দোহার আল রাইয়ানের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে।
এই ম্যাচের পর দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ও বর্তমান কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে লড়বে টোটাল ফুটবলের জনক ও তিনবারের বিশ্বকাপ রানার্সআপ হল্যান্ড। দোহার লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে এই ম্যাচটি শুরু হবে রাত ১টায়। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দু’দলই নিজ নিজ ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালের টিকিট কাটতে মরিয়া। তবে ক্রোয়েশিয়া ও হল্যান্ডও দুই পরাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অভিন্ন লক্ষ্য পূরণের কথা জানিয়েছে।
এবারের ২২তম বিশ্বকাপে হট ফেভারিট হয়েই খেলছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ও নেইমারের ব্রাজিল। গ্রুপ পর্বে দু’টি দলই অপ্রত্যাশিতভাবে হেরেছে একটি করে ম্যাচ। তবে ম্যাচ বাই ম্যাচ উন্নতি করে চলেছে দক্ষিণ আমেরিকার দুই পরাশক্তি। বিশেষ করে শেষ ষোলোতে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোলে হারানোর ম্যাচে অনিন্দ্য সুন্দর ফুটবল উপহার দিয়েছে সেলেসাওরা।
নেইমার, রিচার্লিসন, ভিনিসিয়াসদের সাম্বা ছন্দে রীতিমত নাকাল হয়েছে এশিয়ার পাওয়ার হাউস দক্ষিণ কোরিয়া। ওই ম্যাচে সাম্বা ছন্দের প্রতিনিধিদের পারফরমেন্স স্মরণ করিয়ে দিয়েছে নব্বইয়ের দশকের অপ্রতিরোধ্য ব্রাজিলকে। ছন্দের এই সুর ধরে রেখে এবার আরেকধাপ এগিয়ে যাওয়ার পালা কোচ তিতের দলের।
অন্যদিকে সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে অপ্রত্যাশিত হারে বিশ্বকাপ মিশন শুরু হয় আর্জেন্টিনার। কিন্তু অধিনায়ক মেসির জাদুকরী পারফরমেন্সে শুরুর শঙ্কা কাটিয়ে আলবিসেলেস্তারা দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শেষ ষোলোতে অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ গোলে হারানো দলটির অবশ্য শেষ আটে কঠিন পরীক্ষা। হল্যান্ডের বিরুদ্ধে সার্বিক লড়াইয়ে পিছিয়েই আছে তারা।
তার ওপর ডাচ কোচ লুইস ভ্যান গাল ২০১৪ বিশ্বকাপে টাইব্রেকারে হারের বদলা নেওয়ার হুঙ্কার দিয়ে রেখেছেন। তবে এসব পাত্তা দিচ্ছে না আর্জেন্টিনা। তাদের প্রধান ভরসার নাম অধিনায়ক মেসি। রেকর্ড সর্বোচ্চ ছয়বারের ফিফা সেরা ও সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী তারকা একাই ম্যাচের ফল পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। আর তাই ডাচ কোচ বিষয়টি স্বীকার করে মেসিকে অকেজো করার ছক কষছেন বলে জানা গেছে।
ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বসেরা হতে পারেনি। রেকর্ড সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল সবশেষ বিশ্বকাপের সোনার ট্রফি জিতেছে সেই ২০০২ সালে। সময়ের হিসেবে ২০ বছর বিশ্বসেরা হতে পারেনি সেলেসাওরা। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার অবস্থা আরও করুণ। কিংবদন্তী দিয়াগো ম্যারাডোনার হাত ধরে আলবিসেলেস্তারা সেই ১৯৮৬ সালে সবশেষ বিশ্বজয় করেছে।
দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এরপর গুনে গুনে তিন যুগ অতিবাহিত করেছে। কিন্তু সোনার ট্রফি আর ছুঁয়ে দেখতে পারেনি। ৩৬ বছর ধরে বিশ্বকাপ ট্রফির জন্য হাহাকার করছে আর্জেন্টিনা। অনেক ফুটবল বিশেষজ্ঞ এবার আশার আলো দেখছেন। তাদের মতে, ব্রাজিলের ২০ বছর কিংবা আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান মরুর বুকে হয়ে যেতে পারে।
২০০২ সালে জাপান-কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ জয় করে ব্রাজিল। এরপর ২০০৬ সালে ইতালি, ২০১০ সালে স্পেন, ২০১৪ সালে জার্মানি ও ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ জয় করে ফ্রান্স। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সবশেষ ২০১৪ সালে ফাইনাল খেলেছিল আর্জেন্টিনা। ওই বছর সেমিফাইনাল খেলেছিল ব্রাজিল। এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, আধুনিক সময়ে লাতিন আমেরিকার নান্দনিক ফুটবলের ধার অনেকটাই কমেছে! ইউরোপের গতিময় ফুটবলের সামনে খেই হারিয়ে ফেলছে লাতিনের পাওয়ার হাউজগুলো।
২০০২ সালের পর যে চারটি বিশ্বকাপ হয়েছে, তার প্রতিটিতেই ইউরোপের গতির কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছে লাতিনের নান্দনিক ফুটবল। অথচ লাতিনের অধিকাংশ ফুটবলারই খেলেন ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোতে। তবে এবার প্রেক্ষাপট কিছুটা বদলেছে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দু’টি দলই আছে বেশ ছন্দে। যে কোনো একটি দলের ফাইনালে খেলাও অনেকটা নিশ্চিত। সেই স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে আপাতত আজ রাতে নিজ নিজ ম্যাচ জিততেই হবে দেশ দু’টিকে।
ক্রোটদের বিরুদ্ধে আলো ঝলমলে পরিসংখ্যান নিয়ে মাঠে নামছে ব্রাজিল। এই দলটির কাছে এখন পর্যন্ত হারেনি সেলেসাওরা। অর্থাৎ ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে আগের চার দেখাতেই অপরাজিত আছে সাম্বা ছন্দের দেশ। এর মধ্যে জয় তিনটিতে, অপর ম্যাচ ড্র হয়। আজকের আগে বিশ্বকাপে দু’দলের দুইবারের দেখায় শতভাগ সফল ব্রাজিল। ২০০৬ বিশ্বকাপে ১-০ এবং ২০১৪ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।
আট বছর আগে গ্রুপ পর্বের ওই ম্যাচে নেইমার করেছিলেন জোড়া গোল। চোট কাটিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ফিরে দারুণ খেলা এই সুপারস্টার ক্রোটদের বিরুদ্ধে সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার লক্ষ্যেই ময়দানি লড়াইয়ে নামছেন।
ব্রাজিলের সামনে কখনও দাঁড়াতে না পারলেও ক্রোয়েশিয়ার সবশেষ বিশ্বকাপ পরিসংখ্যান অবশ্য হৃষ্টপুষ্ট। বিশ্বকাপে নিজেদের সবশেষ ১১ ম্যাচের দশটিতেই অপরাজিত ক্রোটরা। তাদের একমাত্র হার ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ৪-২ গোলে। এবারের আসরে এখন পর্যন্ত খেলা চার ম্যাচের মধ্যে কেবল একটিতে নির্ধারিত ৯০ মিনিটের মধ্যে জিতেছে ক্রোয়েশিয়া। গ্রুপ পর্বে কানাডার বিরুদ্ধে পায় ৪-১ গোলের জয়।
আর মরক্কো ও বেলজিয়ামের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে। এরপর শেষ ষোলোয় জাপানের বিরুদ্ধে নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় ১-১ গোলে সমতা থাকার পর টাইব্রেকারে জয় পায় ৩-১ গোলে। এছাড়া বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত তিনবার টাইব্রেকারের পরীক্ষা দিতে হয়েছে ক্রোয়েশিয়াকে। অবাক করা বিষয়, প্রতিবারই সফল হয়েছে তারা।
২০১৮ সালে শেষ ষোলোয় ডেনমার্কের পর কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক রাশিয়াকে পরাজিত করে তারা। এ ধারা ধরে রেখে এবার কাতারে সূর্যোদয়ের দেশ জাপানকে হারিয়েছে ক্রোটরা।
অন্যদিকে আর্জেন্টিনা ও হল্যান্ডের মুখোমুখি লড়াইয়ে বরং কিছুটা এগিয়ে আছে ডাচরাই। সব মিলিয়ে দল দু’টি আজ রাতের ম্যাচের আগে মুখোমুখি হয়েছে ৯ বার। যেখানে চার ম্যাচ জিতে এগিয়ে ডাচরা। মূল ম্যাচে আর্জেন্টিনার জয় মাত্র একটি। তবে আরও দুবার আলবিসেলেস্তারা মূল ম্যাচ ড্রয়ের পর জিতেছে টাইব্রেকারে। বাকি দুই ম্যাচ ড্র হয়। এই হিসেবে টাইব্রেকারে জয় বাদ দিলে বিশ্বকাপে হল্যান্ডকে ৪৪ বছর হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা।
ডাচদের বিরুদ্ধে বিশ্বমঞ্চে আলবিসেলেস্তাদের সবশেষ জয় সেই ১৯৭৮ বিশ্বকাপে ৩-১ গোলে। ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা জিতলেও সেটা ছিল টাইব্রেকারে। সেবার নির্ধারিত ৯০ ও অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা গোলশূন্য ড্র থাকার পর টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা জয় পেয়েছিল ৪-২ গোলে। টাইব্রেকারসহ ফলাফল একত্রিত করলে বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত দু’দল খেলেছে পাঁচবার। এর মধ্যে দু’দলই জিতেছে দু’টি করে ম্যাচ। একটি ম্যাচ ড্র হয়। বিশ্বকাপে হল্যান্ড সবশেষ আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছে ১৯৯৮ সালে। সেবার ডাচদের জয় ছিল ২-১ গোলে।