গাড়িতে সিটবেল্ট না আটকানোয় জরিমানা গুনতে হয়েছে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের। সম্প্রতি তিনি গাড়ি চড়ে লন্ডন থেকে ল্যাংকশায়ার যাচ্ছিলেন। ব্লেজার-টাই পরিহিত প্রধানমন্ত্রী গাড়িতে রয়েছেন সিটবেল্ট ছাড়াই—এমন একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয় সমালোচনা। ইংল্যান্ডে এটা অপরাধ বলে গণ্য হয়। এজন্য সর্বোচ্চ ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকে ১০০ পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে। এই ঘটনার পর ক্ষমা চান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, চলন্ত গাড়িতে কিছুক্ষণের জন্যই তিনি সিটবেল্ট খুলেছিলেন। আপনারা যে ভিডিও দেখছেন, তা ওইটুকু সময়েরই। কিন্তু ক্ষমা চেয়েও রেহাই মেলেনি। চলন্ত গাড়িতে সিটবেল্ট না পরার কারণে তাকে জরিমানা করা হয়েছে।
ব্রিটেনের এই ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। হতাশারও বটে। সামান্য পুলিশের কাছে যদি একজন মানির মান যায়, তাহলে একটা দেশ কোথায় এগোলো একজন প্রধানমন্ত্রী সিটবেল্ট না-ই আটকাতে পারেন। তাই বলে তাকে জরিমানা করা হবে? তিনি তো আর মানুষ খুন করেননি। রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা পাচারও করেননি। তাহলে তাকে কেন জরিমানা দিতে হবে? ঐ ঘটনা প্রমাণ করে, গণমান্য ব্যক্তিদের জন্য আমাদের প্রিয় স্বদেশ অনেক এগিয়ে। আমাদের হোমরাচোমরারা যখন রাস্তায় চলাচল করেন, তখন তাদের জন্য রাস্তা ফাঁকা করে দেওয়া হয়। সাধারণ পথচারীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রেখে গণমান্যদের চলাচলের অবাধ সুযোগ করে দেওয়া হয়। সিটবেল্ট আটকানো তো দূরের কথা, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের জন্য সাতখুনও মাপ। শুধু হোমরাচোমরা ব্যক্তিরাই নন, আমাদের দেশের বাইকওয়ালারা পর্যন্ত হেলমেট ছাড়া দাপিয়ে বেড়ান। এক বাইকে তিন জন উঠে গতির নেশায় মত্ত হলেও তাদের কিছু বলা হয় না। পুলিশরা পর্যন্ত তাদের সমীহ করেন। পুলিশ যদি সাহস করে কাউকে আটকায়, তাহলে কোনো হোমরাচোমরার ফোন আসে, ‘আপনি কাকে হয়রানি করছেন, জানেন এক্ষুনি ওকে ছেড়ে দিন। নিজের কাজ করুন, বাড়াবাড়ি করবেন না।’ নিজের কাজ হচ্ছে—চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাবান দাপট দেখানো ব্যক্তিদের অনিয়মের মহোত্সব উপভোগ করা। ঠেলাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, রিকশাওয়ালাদের কোনো গুরুতর অনিয়ম পেলে একটা গালি দেওয়া, প্রয়োজনে পাছায় একটা লাঠির বাড়ি মারা! আমাদের দেশে সড়ক পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব এটুকুই। এখানে মন্ত্রী-এমপিদের ঘাটানোর সাহস পুলিশের বাবারও নেই। সে তুলনায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সত্যিই হতভাগা। সামান্য সিটবেল্ট না-আটকানোর কারণে যদি জরিমানা দিতে হয়, তেমন দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো!
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও আশ্চর্য কাণ্ড ঘটিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদরা যেখানে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নানা রকম সাধ্যসাধনা করেন, প্রধানমন্ত্রী হতে, পদ ধরে রাখতে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেন, সেখানে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছেন। প্রায় ছয় বছর সাফল্য ও সুনামের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর হঠাৎ এই পদ হতে সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে তিনি যা বলেছেন, সংক্ষেপে তা হলো :প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশকে তার দেওয়ার আর কিছু নেই। তিনি চান নতুন কেউ দায়িত্ব নিক, দেশকে নতুন নেতৃত্ব দিক।
কী আশ্চর্য মানসিকতা, কী মারাত্মক কথা! এ যুগে কোনো পাগল ছাড়া কেউ বলে! এমন নয় যে তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অনেক ক্ষোভ, তিনি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ! বরং বাস্তব পরিস্থিতি উলটো। নিউজিল্যান্ডের মানুষের কাছেও তিনি অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তার বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক ব্যর্থতার অভিযোগ নেই, নেই কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। তবু তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছেন।
আরডার্ন নিউজিল্যান্ডে জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে, জনগণ তাকেই চায়। তার বয়সও খুব বেশি নয়। বয়স, শারীরিক ফিটনেস সবই ঠিক আছে। ৩৭ বছর বয়সে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এখন তার বয়স মাত্র ৪২। আমাদের দেশে কোনো কোনো ছাত্রনেতার বয়সও তার থেকে বেশি।
তার পরও ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেন নিউজিল্যান্ডের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। বর্তমান বিশ্বে এমন একজন সাহসী, দক্ষ ও সৎ রাজনীতিবিদ এবং প্রধানমন্ত্রী সত্যিই বিরল। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এমন একজন নেত্রীর আকস্মিক দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণার পর তার দলের কেউই বলেন নাই যে, নিউজিল্যান্ডে জেসিন্ডা আরডার্নের বিকল্প নেই। একজনও তাকে প্রধানমন্ত্রী থাকার জন্য অনুরোধ করেননি। কোনো কর্মীই বলেননি যে, তারা এই সিদ্ধান্ত মানবেন না।
নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখলে সত্যিই সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। আমাদের দেশে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকার সাধনা চলে। এখানে সবকিছুতে ছাড় আছে, শুধু ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। এ ব্যাপারে, বাম, ডান, ইসলামি দল, জাতীয়তাবাদী, আন্তর্জাতিকতাবাদী সবার ভূমিকা এক।
একই পৃথিবী, একই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, অথচ নিউজিল্যান্ড আর বাংলাদেশের মধ্যে কী বিশাল পার্থক্য! জেসিন্ডা আরডার্নরা ছাড়তে জানেন। রাজনীতি মানেই দখলদারি নয়। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা নয়, শুধু ক্ষমতার আস্ফাালন নয়। হেরে যাওয়ার পরেও পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চলে প্রতিনিয়ত। ক্ষমতার স্বাদ এতই মধুর যে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ হত্যা পর্যন্ত জায়েজ মনে করা হয়। ক্ষমতার স্বাদ পেতে হিংস্র পিশাচের সঙ্গে কোলাকুলি করতেও কারোর বিবেকে বাধে না।
৪২ বছর বয়সি জেসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, তার ভবিষ্যতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তিনি সময় নিয়েছেন। প্রচুর চিন্তাভাবনা করেছেন। তিনি আশা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি হয়তো তার প্রাণশক্তি ফিরে পাবেন। ‘কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমি সেটা পাইনি এবং আমি যদি আমার কাজ অব্যাহত রাখি তাহলে আমি নিউজিল্যান্ডের ক্ষতি করব।’
আমাদের দেশে রাজনীতি মানে শুধু চাওয়া। আমৃত্যু পদে থেকে যাওয়া। রাজনীতি এখানে পেশা। পেশা চলে বাজারের নিয়মে। লাভক্ষতির অঙ্ক কষে। সেখানে দেশ ও দশের কল্যাণের কথা বলা হলেও আত্মকল্যাণ ছাড়া ভিন্ন কিছু কদাচিৎ ঘটে।
জেসিন্ডা আরডার্ন পদ কেন ছাড়ছেন, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্ববাসীর কাছে সেই প্রশ্ন থেকেই যাবে। আমাদের দেশেসহ ভারতবর্ষে ঠিক উলটো প্রশ্ন। ব্যর্থ, বাতিল, অযোগ্য নেতারা কেন পদ আঁকড়ে আছেন, এত অভিযোগের পরেও! আসলে গণতন্ত্রের মানে আমাদের দেশে এক রকম, নিউজিল্যান্ডে আরেক রকম! পুনশ্চ :পরিশেষে একটা বিখ্যাত গল্প। রাজা আবহাওয়া বিভাগের প্রধানকে ডেকে জিগ্যেস করলেন, আমি মত্স্য শিকারে যেতে চাই, আজকের আবহাওয়া কেমন থাকবে? সে বলল, আজকে সুন্দর উজ্জ্বল চমৎকার আবহাওয়া থাকবে জাহাঁপনা, আপনি যেতে পারেন। রাজা বের হলেন।
রাজা যখন সাগরপাড়ে গেলেন, সাগরপাড়ে এক জেলে ছাগল চড়াচ্ছিল, সে বলল, মহারাজ, আজকে কেন আপনি সাগরে যাচ্ছেন? একটু পরে তো বৃষ্টি হবে! রাজা বললেন, ব্যাটা জেলের বাচ্চা, তুই কী জানিস? আমি আবহাওয়া বিভাগ থেকে পাকা খবর জেনেই এসেছি। রাজা সাগরে গেলেন, কিছুক্ষণ পর শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি!
রাজা প্রাসাদে ফিরে এসে আবহাওয়া বিভাগের প্রধানকে বরখাস্ত করে ঐ জেলেকে ধরে এনে আবহাওয়া বিভাগের প্রধান বানিয়ে দিলেন!
জেলে পড়ল বিপদে, সে তো আবহাওয়ার কিছুই জানে না। রাজদরবারে গিয়ে জেলে বলল, মহারাজ, আমাকে ঘরে ফিরে যেতে দিন। আমি আসলে আবহাওয়ার কিছু জানি না।
রাজা বললেন, তাহলে ঐদিন আমার আবহাওয়া বিভাগের থেকেও সঠিক খবর তুই কী করে দিলি?
জেলে উত্তর দিল, মহারাজ, সেখানে আমার কোনো কৃতিত্ব ছিল না! সব কৃতিত্ব আমার ছাগলের! বৃষ্টি আসার আধাঘণ্টা আগে থেকে ছাগলটা ঘনঘন মুততে থাকে! এর থেকে আমি বুঝতে পারি, একটু পর বৃষ্টি হবে!
তারপর রাজা জেলেকে ছেড়ে দিয়ে তার ছাগলটাকে ধরে এনে আবহাওয়া বিভাগের প্রধান বানিয়ে দিলেন!
সেই থেকেই সে রাজ্যে বড় পদগুলোতে ছাগল নিয়োগ দেওয়ার রীতি চালু হয়েছিল!