২০০১ সালের ৯ ফেরুয়ারি। সবেমাত্র কমতে শুরু করেছে শীত। পুরোনো পাতাগুলো ঝরে পড়ছে গাছ থেকে। এমন দিনে আমাদের গ্রামের একটা নক্ষত্র ঝরে যায়। দিনের মধ্যভাগে খবর পেলাম আমাদের প্রতিবেশী ‘ডাইরেক্টর’ মারা গিয়েছেন। কিসের ডাইরেক্টর ছিলেন তিনি, তা বোঝার মতো বোধ হয়নি তখনো প্রাথমিকের গণ্ডি অতিক্রম না করা আমার। রাত আটটার সংবাদে তার একটা পোট্রের্ট ছবি দেখিয়ে করুণ সুরে সংবাদ পাঠিকা সেই মৃত্যুর সংবাদ দিলেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক (মূলত মহাপরিচালক, তখন পরিচালক বলা হতো) ড. এম আমীরুল ইসলাম মারা গিয়েছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তার সংক্ষিপ্ত জীবনীও তুলে ধরেন সংবাদ উপস্থাপিকা। তার দু-এক দিন পর মরদেহ আনা হয় নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার অর্জুনতলা ইউনিয়নের অর্জুনতলা গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।
দেশের জনসংখ্যা ৭ কোটি থেকে ১৬ কোটিতে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন আবাসন, শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট ও নানান উন্নয়ন অবকাঠামো তৈরি হয়ে কমেছে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ।
এরই মধ্যে দেশে বারবার অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলেও কখনো সংকট তৈরি হয়নি খাদ্যে। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে ঠিকই; কিন্তু খাদ্যে ধান-চালে কখনো সংকট তৈরি হয়নি। বরং শ্রীলঙ্কাসহ নানান দেশে রপ্তানি করা গেছে ধান-চাল। দুর্যোগে ধান-চাল নিয়ে প্রতিবেশী দেশের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। কী জাদুর কাঠির বলে ধান-চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ?
যে জাতির সকালের শুরু হয় চালের তৈরি খাবার দিয়ে এবং রাতের খাবারেও চাই ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। যে জাতির সন্তানরা বিলেত গেলে দু-তিন দিন ভাত না খেলে তার হৃদয়ে হাহাকার তৈরি হয় একটুখানি ডাল ভাতের জন্য, সে জাতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ড. এম আমীরুল ইসলামের জীবনীতে একটু চোখ বুলালেই আমরা বুঝতে পারব দেশের আজকের আধুনিক, স্বনির্ভর কৃষির গোড়াপত্তনটা কীভাবে হয়েছিল। কী অবদান ছিল এই প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর!
ড. এম আমীরুল ইসলাম ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে নোয়াখালীর সেনবাগে উপজেলার অর্জুনতলা গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪১ ও ১৯৪২ সালে রসায়ন শাস্ত্রে যথাক্রমে বিএসসি অনার্স এবং এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে তিনিই প্রথম রসায়নশাস্ত্রের বিএসসি অনার্স কোর্সে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি ক্যারিয়ারের শুরুতে All India Corporation-এ চাকরি করার পর ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে থেকে ১৯৪৯ সালে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে পিএইচডি লাভ করেন। ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫০-১৯৬১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কৃষি রসায়নবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মৃত্তিকা শ্রেণি বিন্যাসের অগ্রদূত। এছাড়া তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে কৃষকের জমিতে সার নিয়ে পরীক্ষা কার্যক্রম এবং সার প্রয়োগ নির্দেশিকা প্রস্তুত করা। তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত মৃত্তিকা জরিপ বিভাগের প্রথম পরিচালক এবং মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি মৃত্তিকাসংক্রান্ত আধুনিক জরিপ কাজ শুরু করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগ দান করেন। এরপর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১-৭২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (সে সময় পরিচালক বলা হতো) ছিলেন। চাকরি জীবনের শেষ দুই বছর (১৯৭৭-১৯৭৮) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বার ছিলেন। তিনি USAID, IFDC, FAO, CIRDAP, UNDP প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন । Advances in Agronomy এবং Soil Science textসহ তার গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা ৬০টি ।
দেশের বৈচিত্র্যময় কৃষি পরিবেশ অঞ্চলসমূহে ধান উৎপাদনের সমস্যা ও সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ ও সে বিষয়ে গবেষণার জন্য দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে ১১টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে।
যেখানে কাজ করছেন তিন শতাধিক বিজ্ঞানী। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ১০৩টি ইনব্রিড ও আটটি হাইব্রিডসহ ১১১টি উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে।
এর মধ্যে লবণাক্ততা সহনশীল ১০টি জাত, রোপা আমন মওসুমে খরা সহনশীল চারটি জাত, জলামগ্নতা সহনশীল পাঁচটি জাত, পুষ্টিসমৃদ্ধ ছয়টি জাত এবং রপ্তানিযোগ্য চারটি জাত রয়েছে। বিখ্যাত কালিজিরা এবং কাটারিভোগ ধান বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। ধান গবেষণা এবং ধানের জাত উদ্ভাবনে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট মর্যাদাপূর্ণ ২৬টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। দেশের ধান গবেষণায় এমন সব সাফল্যের সূচনা করেছেন ড. এম আমীরুল ইসলামই।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ছিল বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গৌরব ও সাফল্যের ৫০ বছর।