ব্যাংক খাতে দেশের সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
মঙ্গলবার এক মামলার শুনানিকালে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন। পরে চার ব্যাংক কর্মকর্তাকে জামিন না দিয়ে ৪ সপ্তাহের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন আদালত।
শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, সবচেয়ে সাংঘাতিক ক্রাইম (অপরাধ) হচ্ছে ব্যাংকে। ব্যাংক খাতে বড় বড় অপরাধ হচ্ছে। দেশটাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এভাবে চললে দেশ এগোবে কীভাবে?
ঋণ জালিয়াতিসংক্রান্ত দুর্নীতির এ মামলায় একটি ব্যাংকের চার কর্মকর্তা মঙ্গলবার সকালে হাইকোর্টে হাজির হন। তারা আগাম জামিন চান। শুনানিতে আসামিদের উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেন, ‘আপনাদের ভেতরে (জেলে) পাঠাতাম, তবে টাকার পরিমাণ কম হওয়ায় আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।’ আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফৌজিয়া আক্তার পপি। পরে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, হাইকোর্ট আসামিদের আগাম জামিন না দিয়ে ৪ সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। আর ব্যাংক কর্মকর্তাদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ড. মাহবুব মোর্শেদ। আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ শাখার ইসলামী ব্যাংকের চার কর্মকর্তা একটি ঋণ কেলেঙ্কারির মামলায় হাইকোর্টে আগাম জামিন নিতে এসেছিলেন। আদালত তাদের জামিন না দিয়ে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সময় হাইকোর্ট ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কিছু মন্তব্য করেন।
জানা যায়, দুদকের রাজশাহীর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে ২০ মার্চ মামলাটি করেন কমিশনের উপসহকারী পরিচালক সুদীপ কুমার চৌধুরী। ব্যাংকের শিবগঞ্জ শাখা থেকে পরস্পর যোগসাজশে ভুয়া ঋণ হিসাব খুলে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের অভিযোগে দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ও ১০ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ ধারায় মামলাটি করা হয়। আসামিরা হলেন-ব্যাংকটির শিবগঞ্জ শাখার বরখাস্ত এসবিআইএসও মো. ফয়েজুর রহমান, সাবেক বিনিয়োগ ইনচার্জ মো. আবু বকর, ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মো. মনিরুজ্জামান খান, ব্রাঞ্চের প্রধান মো. আফজাল হোসেন ও ব্যাংকটির কনিষ্ঠ কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম।
ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকেত : দেশে সবচেয়ে বড় অপরাধ ব্যাংক খাতে সংঘটিত হয়-হাইকোর্টের এমন মন্তব্যের সঙ্গে যুগান্তরের কাছে একমত প্রকাশ করেছেন ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। পরিচালনা পর্ষদ থেকে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাই কম-বেশি অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। এটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত। এ অবস্থা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে ঋণ অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট। এর ফলে বাড়ছে ঋণখেলাপি এবং অর্থ পাচার। আর এসব লুটপাটের সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জড়িয়ে যাচ্ছেন। এটা এখন একটা দুষ্টচক্রে পরিণত হয়েছে। সে কারণে আদালতের পর্যবেক্ষণে বিষয়টি উঠে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনিয়ম-দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এসব বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া যায় না। দ্রুত এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে।
আদালতের এমন মন্তব্যের সঙ্গে শতভাগ সহমত প্রকাশ করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সুশাসনের অভাব। উচ্চ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষেরও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। যা মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে ব্যাংক খাতে সুশাসন বলতে কিছুই নেই। সর্বত্র অসৎ প্রবণতা বিরাজ করছে। পরিচালকরা ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন। আবার সে ঋণ অবলোপন করছেন। এসব কিছু ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত মনে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে একটাই পথ-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাউকে ছাড় দেবে না। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সৎ, যোগ্য, দক্ষ পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। ব্যাংকাররাও সততার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে।
জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার মোহাম্মদ নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, কয়েকটি ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের অনেক ঘাটতি আছে। এটা সত্য। তবে সব ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নয়। নেতিবাচক প্রভাবটা সার্বিকভাবে পড়েছে। এছাড়া বেশকিছু বড় বড় অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। সে কারণে আদালত সংক্ষুব্ধ হয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যতটা দ্রুত সম্ভব আর্থিক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। কোনো অবস্থায় খাতটিকে শেষ করে দেওয়া যায় না। কারণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবদান অনেক বেশি-তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।