যাকে ইংরেজিতে সোশ্যাল মিডিয়া বলা হয়, এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন অসামাজিকতার ছড়াছড়ি। আমরা প্রযুক্তির কল্যাণকর দিকগুলো অবশ্যই অস্বীকার করতে পারি না। প্রযুক্তির ছোঁয়া মানুষকে দিয়েছে উন্নত সভ্যতা, বাড়িয়েছে জীবনযাত্রার মান। সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৭০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত রয়েছে। তরুণদের মধ্যে এ হার আরো বেশি, প্রায় ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ফেসবুক চালাচ্ছেন যাচ্ছেতাইভাবে! অনলাইনে স্ক্রল করলেই এখন অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ রিলস ও শর্ট ভিডিও চোখে পড়ে, যা নিতান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা অনেকেই কাজের ফাঁকে মানসিক ক্লান্তি দূর করার জন্য অনলাইনের আশ্রয় নিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত নানা কনটেন্ট সামনে চলে আসে। এতে কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় অনেক ক্ষেত্রে। আজকের দিনে সবই যেন নিজেকে ভাইরাল করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ! এই কাল্পনিক ট্রেন্ড থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা অতীব জরুরি।
অনেক সময় অন্যের অনুমতি না নিয়েই কেবল ভাইরালের নেশায় অসংগতিপূর্ণ ভিডিও ছেড়ে দিই, যা অন্য ব্যক্তিকে রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। এতে প্রাণনাশের ঝুঁকিও থেকে যায়। জরিপে দেখা গেছে, মেয়েদের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের ৬০ শতাংশই খারাপ মানের ঘুম ও সাইবার উত্ত্যক্তের জন্য হয়ে থাকে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে ‘গুজব’। ভাইরালের আশায় আমরা ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র—কোনো ক্ষেত্রেই গুজব ছড়াতে ন্যূনতম চিন্তাভাবনা করি না। এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যে বছরটা আমরা পার করে এসেছি তথা গত বছর অন্তত ১ হাজার ৪০০ ‘গুজব’ অনলাইনে ছড়িয়েছিল? অবাক লাগলেও বিষয়টি সত্য। কাজেই যে কোনো কিছু দেখা মাত্র বিশ্বাসের চর্চা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। অতি সম্প্রতি সার্টিফিকেট পোড়ানোর ইস্যু নিয়ে নেটিজেনদের একটি অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভীষণ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একাংশ বলছেন, এটি যুবসমাজের যোগ্যতা ও দক্ষতাকে উপেক্ষা করে ভাইরাল হওয়ার দিকে উৎসাহিত করছে, যা সমীচীন নয় কোনোভাবেই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমের সঙ্গে বাস্তব জীবনের অনেক তফাত। যুবসমাজ এখন লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে হাজারো তরুণ-তরুণী বিপথগামী হচ্ছে, মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে, পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে, খেলাধুলা ছেড়ে দিয়ে দিনরাত ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। এটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স বিভাগের পরিচালক ড. পিটার হোয়াইব্রোর মতে, ডিজিটাল স্ক্রিন হলো ইলেকট্রনিক কোকেনের মতো। চীনা গবেষকরা একে বলছেন ‘ডিজিটাল হেরোইন’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত ব্যক্তি বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে পার্থক্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এমতাবস্থায় যে কোনো জিনিসের ব্যাবহারিক প্রয়োগবিধি জানা তথা এর সারকথা অনুধাবন অত্যন্ত জরুরি।
সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের পরিসরকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝে নেওয়া তাই অতীব জরুরি। সম্পর্কের সমানুপাতিক সমীকরণ মগজের মধ্যে গেঁথে নেওয়া দরকার এখনই। কীসে আমাদের সাড়া দেওয়া উচিত, কীসে হইচই করা উচিত নয়, এসব বিষয় বুঝতে না পারলে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদেরকে ক্রমাগতভাবে গ্রাস করে ফেলবে! আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের থেরাপি, স্কিল-বিল্ডিং ট্রেইনিংসহ বিভিন্ন কার্যকর পদ্ধতির মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া ও ভাইরাল আসক্তি থেকে বের হয়ে আসা সময়ের দাবি।